ওরা হারিকেন জ্বালিয়েছে। হারিকেন নিয়ে আয়নাঘরেই বোধহয় আসছে। লিলিয়ান কাবার্ড ছেড়ে পালাবার জন্যে কাবার্ডের দরজায় হাত রাখল, আর ঠিক তখন কাবার্ডের ভেতর কী যেন একটা নড়ে উঠল। ঝুনঝুন শব্দ হলো। একজন কেউ কোমল ভঙ্গিতে হাত রাখল তার পিঠে। লিলিয়ান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাসের শব্দও যেন শুনল।
কী হচ্ছে লিলিয়ানের? সে কি পাগল হয়ে গেছে? তার কি হেলুসিনেশন হচ্ছে? সে এখন কী করবে? চিৎকার করে উঠবে? তাতে লাভ কী? পিঠে যে হাত রেখেছে সে হাত সরিয়ে নিচ্ছে না। যেন তাকে বলার চেষ্টা করছে–ভয় নেই। কোনো ভয় নেই। আয়নাঘরে তুমি নিশ্চিন্ত মনে অপেক্ষা কব। এরা তোমাকে কিছুতেই খুঁজে পাবে না। লিলিয়ান মনে মনে বলল, আপনি যেই হোন, আমার স্বামীকে রক্ষা করার চেষ্টা করুন। ও বিপদে পড়েছে। ওব বিপদ আমার চেয়েও ভয়ঙ্কর বিপদ। আমি বুঝতে পারছি। আমি খুব পবিষ্কার বুঝতে পারছি।
তাহেরের সিগারেট অনেক ছোট হয়ে এসেছে। সিগারেটের শেষ অংশ এখনই নদীর জলে ফেলে দিতে হবে। এরা সম্ভবত সিগারেট শেষ করার জন্যে অপেক্ষা করছে। তাহের বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কী চান?
বৃদ্ধ খিকখিক করে খানিকক্ষণ হাসল। সে একাই হাসছে। অন্য কেউ হাসছে না। বৃদ্ধ হাসি থামিয়ে বলল, বিলাত দেশটা কেমন এন্টু কন তো হুনি।
বিলেতের খবর আমি জানি না। আমি থাকি আমেরিকায়।
আমার কাছে আমরিকা বিলাত এক জিনিস।
বৃদ্ধ চাদরের নিচে হাত ঢুকালো। তাহের জ্বলন্ত সিগারেট হাতে লাফিয়ে পড়ল নদীতে। পানির টান প্রবল। তাহেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এরা কি তাহেরকে ছেড়ে দেবে? মনে হয় না। নৌকা নিয়ে এরা তাকে খুঁজবে। তন্নতন্ন করে খুঁজবে। তাহের ভাবার চেষ্টা করছে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু। খুব বেশি নয়। সম্ভাবনা ক্ষীণ, কারণ তাহের সাঁতার জানে না।
লিলিয়ান আয়নাঘরের কাবার্ডে বসে আছে। কী গাঢ় অন্ধকার! এই অন্ধকার মাতৃগর্ভের অন্ধকার। কোনো মানুষের পক্ষে এই অন্ধকার সহ্য করা সম্ভব নয়।
হঠাৎ করে অন্ধকার কমে গেল। তিনজনের দলটা আয়নাঘরে ঢুকল। কাবার্ডে বসে থাকার অর্থ হয় না। লিলিয়ান ঠিক করল সে দরজা খুলে বের হবে। বলবে, কী চাও তোমরা?
লিলিয়ান দরজা খুলতে পারল না। যে লিলিয়ানের পিঠে হাত রেখেছিল। সে এবাব লিলিয়ানের হাত চেপে ধরল। নরম হাত। হাত ভর্তি চুড়ি। রিনারিন করে চুড়ি বেজে উঠল। এসব কি স্বপ্নে ঘটছে?
টর্চ হাতের ছেলেটি বলল, কুদ্দুস ভাই, আমার মনে হইতেছে মেম সাব এই ঘরে। ছেন্টের গন্ধ পাইতেছি। মেম সাব শইল্যে ছেন্ট দিছে। হি হি হি… ।
লিলিয়ান শক্ত হয়ে আছে। এই বোধহয় কাবার্ডের দরজা খুলল। ঠিক তখন রান্নাঘরে ঝন করে শব্দ হলো। টিনের একটা কিছু মেঝেতে গড়িয়ে যাচ্ছে। দলেব তিনজনই ছুটে গেল রান্নাঘরের দিকে। দৌড়ে যাবার জন্যে হারিকেনটা নিভে গেল।
যে লিলিয়ানের হাত ধরেছে সে-ই তাকে কাবার্ড থেকে বের করল। টেনে নিয়ে যাচ্ছে পাশের ঘরে। চারদিকে জমাটবাধা অন্ধকার। চাঁদের আলো কোথায়? আজ কি চাঁদ উঠে নি? কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লিলিয়ান অন্ধের মতো অনুসরণ করছে। তার বোধ লুপ্ত। সে কী করছে নিজেও জানে না। তারা দুজন এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা পর্দার আড়ালে। এটা কোন ঘর? লিলিয়ানের সব এলোমেলো হয়ে গেছে। যে তার হাত ধরে আছে সে কে? বা আসলেই কি কেউ তার হাত ধরে আছে?
তিনজনের দলটি এ ঘরে এসেছে। তারা এখন খানিকটা বিভ্রান্ত। একজন বলল, গেল কই? বসির ভাই, গোল কই?
এই ঘর দেখা হইছে?
একবার দেখলাম।
আবার দেখ। পর্দা টান দিয়া ফেলা।
একজন এসে পর্দা ধরল। আর তখন শোবার ঘর থেকে খিলখিল হাসির শব্দ শোনা গেল। কিশোরীর মিষ্টি রিনারিনে গলা। টর্চ হাতের ছেলেটা বলল–হাসে কেডা বসির ভাই, হাসে কেডা?
তিনজন এগুচ্ছে শোবার ঘরের দিকে। এবার আর আগের মতো ছুটে যাচ্ছে না। কিশোরীর হাসির শব্দ আরো বাড়ল। তারপর হঠাৎ করে থেমে গেল। লিলিয়ান মনে মনে বলল, যা ঘটছে সবই আমার কল্পনা। আমার উত্তেজিত মস্তিষ্ক আমাকে এসব দেখাচ্ছে, শোনাচ্ছে। আসলে কেউ আমার হাত ধরে নেই। কেউ আমাকে টেনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে না। আমি নিজেই জায়গা বদল করছি, এবং কল্পনা কবছি। প্ৰচণ্ড ভয়ের কারণে আমার এ রকম হচ্ছে? ডা. ভারমান আমাকে তাই বলতেন।
তারপরেও লিলিয়ান ফিসফিস করে বলল, আপনি কে?
ছোট্ট নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। কোনো জবাব পাওয়া গেল না। লিলিয়ান বের হয়ে এলো পর্দার আড়াল থেকে। নিজের ইচ্ছায় নয়–যে তার হাত ধরে ছিল সেই তাকে টেনে বের করল। সে চরকির মতো ঘুরছে–এ-ঘর থেকে ঐ-ঘরে। যেন এক মজার খেলা। এক সময় লিলিয়ান লক্ষ করল সে লোহার প্যাচানো সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। বাইরের অন্ধকাব্য গাঢ় নয়। অস্পষ্টভাবে সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। এখন আর কেউ তার হাত ধরে নেই। এতক্ষণ যা ঘটেছিল সবই কল্পনা। মস্তিষ্ক তার নিজস্ব নিয়মে তৈরি করেছে বিভ্ৰম, এবং তাকে নিয়ে এসেছে। ঘরের বাইরে। অশরীরী বলে কিছু নেই, কিছু থাকতে পারে না।
লিলিয়ান খুব সাবধানে লোহার সিঁড়ি দিয়ে নামছে এতটুকু শব্দও যেন না হয়। তাকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে। অনেক দূর যেতে হবে, যেন কেউ তার নাগাল না পায়। সিঁড়ি এত দুলছে কেন? মনে হচ্ছে ভেঙে পড়ে যাবে। খুব হাওয়া। উড়িয়ে নিয়ে যাবার মতো হাওয়া। এই ব্যাপারগুলি তো স্বপ্নে ঘটেছিল। এখনো কি সে স্বপ্ন দেখছে? পুরোটাই কি স্বপ্ন? লিলিয়ানের শরীর অবসন্ন, অসম্ভব ক্লান্ত। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। ইচ্ছা করছে সিঁড়ির রেলিং জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। মনে হচ্ছে সে জেগে আছে হাজার বছর ধরে।