খাড়াইযা আছেন ক্যান? আসেন। দেবি কইরা তো কিছু লাভ নাই।
তাহের যন্ত্রের মতো এগুলো। পাকুব গাছের কাছে চাদর গায়ে আর একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। এই গবমে। তার গায়ে চাদর কেন? লোকটা নৌকায় উঠে বসল। তাহের এগুলো যন্ত্রের মতো।
সবাই নৌকায় উঠল না। ছালাম এবং টর্চ হাতে ছেলেটা পাকুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল। দুজন তাহেরের দুহাত ধরে নৌকায় প্রায় টেনে তুলল। চাদর গায়ের লোকটা ছাড়াও নৌকার একজন মাঝি আছে। মাঝি সঙ্গে সঙ্গে নৌকা ছেড়ে দিল। চাদর গায়ের লোকটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আইজ গরম বড় বেশি পড়ছে।
লোকটির গলার স্বরে বোঝা যাচ্ছে সে বৃদ্ধ। তাহেরেব বলার ইচ্ছা করছে— গরম বেশি কিন্তু আপনি চাদর গায়ে দিয়েছেন কেন? তাহের কিছুই বলল না। তাহেরের হাতে সিগারেট, প্যাকেট থেকে বের করে হাতে নিয়েছে। আগুন ধরাতে ভুলে গেছে। যদিও আগুন নেই। তবু তাহের অভ্যাস মতো সিগারেট মুখে দিচ্ছে এবং টানছে।
চাদর গায়ে বুড়ো লোকটি খুকধুক করে কেশে বলল, নৌকা মাঝগাংগে নিয়া চল। লোকটির মাথা থেকে চাদর সরে গেছে। তার মাথার সব চুল সাদা। থুতনির কাছে অল্প কিছু দাড়ি। দাড়ির রঙ কালো। তাহেরের মনে হলো তার বুকের উপর দিয়ে বরফ শীতল পানির একটা স্রোত বয়ে গেল। এরা তাকে খুন করার জন্যে এখানে নিয়ে এসেছে। গ্রামের সব খুনখারাপ হয় নদীর কাছে। নদী হত্যার চিহ্ন ধুয়ে মুছে ফেলে। জলধারার প্রবল স্রোত মৃতদেহ অনেক দূর নিয়ে যায়। জলজ প্রাণী অতি দ্রুত মৃতদেহ নষ্ট করে দেয়। চেনার উপায় থাকে না।
বুড়ো বলল, আপনের সিগারেট নিভা। সিগারেট ধরান। সিগারেট ধরাইয়া আরাম কইরা একটা টান দেন। আহ শালার গরম কী পড়ছে!
তাহেরের বা হাতটা একজন ধরেছিল। সে হাত ছাড়ল। তাহের পকেট থেকে দেয়াশলাই বের করল। তাকাল বুড়োর দিকে। মনে হচ্ছে এই বুড়েই হত্যাকারী। বুড়ো বন্দুক আনে নি। নিশ্চয়ই চাদরের নিচে ছোরা নিয়ে এসেছে। খোলা জায়গায় বন্দুকের আওয়াজ অনেক দূর পর্যন্ত যাবে। সেই তুলনায় ছোরা অনেক নিরাপদ।
বুড়ে বলল, ধরান সিগারেট ধরান।
তাহের সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করছে। ধরাতে পারছে না। বাতাসের বেগ প্ৰবল। তাছাড়া তার হাত কাঁপছে। দেয়াশলাইয়ের চারটি কাঠি নষ্ট হবার পর, পঞ্চম কাঠিটি ধরল। তীব্র ঘামের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ঘামের গন্ধে তার বমি এসে যাচ্ছে।
তাহের দেখল। সবাই এক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কেউ মুহুর্তের জন্যেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছে না। বুড়ো লোকটির মুখ হাসি হাসি। চাঁদের আলোয় হাসিমুখের এই বুড়োকে কী ভয়ঙ্করই না লাগছে।
লিলিয়ানের শোবার ঘর অন্ধকার। হারিকেন নিভে যাওয়ার পর সলতা থেকে বিশ্ৰী ধোঁয়া আসছে। লিলিয়ানের নাক জ্বালা করছে। ঘরে কি কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হয়েছে? তার কি ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত? সিড়ির দরজায় ধাক্কার শব্দ হলো। ভারী গলায় কে বলল–দরজা খুলেন।
লিলিয়ান বলল, কে?
খবর আছে। দরজা খুলেন, Urgent খবর।
লিলিয়ান সিড়ির দরজার কাছে চলে এলো। দরজা খুলল না। তার মন বলছে–দরজার আড়ালে অপেক্ষা করছে ভয়ঙ্কর বিপদ।
খুলেন দরজা। খুলেন।
কে যেন প্ৰচণ্ড শব্দে ধাক্কা দিচ্ছে। লিলিয়ান বলল, Go away.
দরজায় হিংস্র পশুর থাবার মতো থাবা পড়ছে। একজন না, কয়েকজন। লিলিয়ানের মনে হলো–খুব কম করে হলেও তিনজন আছে। লিলিয়ান খিকখিক হাসব শব্দও শুনিল। তিনজনের কোনো-একজন আনন্দে হাসছে। এই আনন্দোবী উৎস কী?
ঐ সাদা চামড়া, দরজা না খুইল্যা কতক্ষণ থাকিবি? আপাসে দরজা খোল।
লিলিয়ান নড়ল না। দাঁড়িয়ে রইল। প্রাচীন ভারী দরজা চট করে ভাঙবে না। ভাঙতে সময় লাগবে। কতক্ষণ সময় লিলিয়ান জানে না। তাহের ফিরে আসা পর্যন্ত কি দরজা তাকে রক্ষা করবে? কিন্তু তাহের? ও কেমন আছে? তারও কি লিলিয়ানের মতোই বিপদ হয় নি? সে কি ফিরে আসতে পারবে? অনেক দিন পর লিলিয়ান তার মাকে ডাকল। ফিসফিস করে বলল, মা, আমি খুব বিপদে পড়েছি।
প্ৰচণ্ড শব্দ হচ্ছে দরজায়। এরা দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। লিলিয়ান কাঁপা গলায় বলল, ঈশ্বর আমাকে রক্ষা কর। দরজার সামনে থেকে তার সরে যাওয়া উচিত। লিলিয়ান সরতে পারছে না। তার পা সিসের মতো ভারী হয়ে আছে–দরজার বাইরের মানুষগুলি পশুর মতো গর্জন করছে।
ভাঙ দরজা। ভাইঙা ধর সাদা চামড়ারে।
দরজা ভেঙে পড়ার কয়েক মিনিট আগে লিলিয়ান সংবিত ফিরে পেল। প্রথম দৌড়ে ঢুকল শোবার ঘরে। সেখান থেকে ছুটে গেল আয়নাঘরে। কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে। আয়নাঘরে লুকানোর জায়গা কোথায়? কাবার্ড কাবার্ড খুলে ভেতরে বসে থাকবে।
লিলিয়ান কাবার্ড খুলে ভেতরে ঢুকল, আর তখনই তিনজনের একটা দল দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ল। এই দলের একজন নিতান্ত চ্যাংড়া। তার হাতে পাঁচ ব্যাটারির একটা টর্চ। তার বয়স পনের-ষোলর বেশি না। সে খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলল–মেম মাগি গেছে কই?
একজন বলল, পালাইছে। হয় খাটের নিচে নয়। আলমিরার ভিতরে।
লিলিয়ান এদের কথা শুনতে পারছে, কিন্তু গ্ৰাম্য টানা টানা কথার অর্থ ধরতে পারছে না। লিলিয়ানের মনে হচ্ছে কাবার্ডে ঢুকে সে বড় ধরনের বোকামি করেছে। এরা প্রথমেই কাবার্ডগুলি খুঁজবে। এক এক করে খুঁজবে। তার উচিত কাবার্ড থেকে বের হয়ে আসা। খোলামেলা জায়গায় থাকা যাতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করতে পারে। কোণঠাসা হয়ে ধরা পড়ার কোনো মানে হয় না।