তাহের ছাদে এলো এগারটার দিকে। বিরক্তমুখে বলল, লিলিয়ান, ছাদের প্রোগ্রামটা–আধঘণ্টা পিছিয়ে দিতে হবে। আমার চাচা খবর পঠিয়েছেন। অত্যন্ত জরুরি কী কথা না-কি এই মুহুর্তে আমাকে বলা দরকার। তার হাঁপানীর টান উঠেছে। তিনি আসতে পারছেন না। তুমি শোবার ঘরে গিয়ে বসে। আমি ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে ছাদে যাব।
তারা ছাদ থেকে নেমে এলো। লিলিয়ান বুঝতে পারছে তাকে একা ফেলে তাহেরের যেতে ইচ্ছা করছে না। লিলিয়ান বলল, আমিও যাই তোমার সঙ্গে?
তিনি বলে দিয়েছেন আমি যেন একা। যাই। তোমার ভয়ের কিছু নেই। তাঁর বড় ছেলেটা এখানে থাকবে।
আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না। তবে উনার ছেলে এখানে না থাকলে ভালো হয়। ছেলেটাকে আমার পছন্দ না। সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তোকানোর ধরনটা ভালো না।
তাকানোর ধরন ঠিকই আছে। ওরা কখনো বিদেশী মেয়ে দেখে নি। তোমাকে অবাক হয়ে দেখছে। এতে যে তুমি অস্বস্তিবোধ করতে পার সেই জ্ঞান ওদের নেই। তাছাড়া সে থাকবে একতলায়, তুমি দোতলায়–অসুবিধা কী। পারবে না। আধঘণ্টা থাকতে?
পারব।
সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিও।
আচ্ছা।
আমি মোটেও দেরি করব না। কথাটা শুনব আর চলে আসব। তাদের যদি ভালো
কোনো শাড়ি থাকে তোমার জন্যে নিয়ে আসব।
থ্যাংকস।
লিলিয়ান সিড়ির দরজা বন্ধ করে শোবার ঘরে চলে এলো। তার হাতে হারিকেন। তাকে একা এক আধঘণ্টা সময় কাটাতে হবে। আধঘণ্টা সময় কিছুই না। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। হিথ্রো এয়াবপোর্ট থেকে তাহের ডাটি জোকস-এর একটা বই কিনেছে। নোংরা রসিকতা পড়তে ভালো লাগে না। তবু সময় কাটানোর জন্যে নিশ্চয়ই পড়া যায়।
লিলিয়ান শ্বেতপাথরের টেবিলে হারিকেন নামিয়ে রাখল। হারিকেনের সম্ভবত কোনো সমস্যা হয়েছে। শিখা দপদপ করছে। নিভে যাবে না তো? লিলিয়ান তাকিয়ে আছে হারিকেনের শিখার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কোনোরকম কারণ ছাড়া আচমকা তীব্ৰ ভয়ে লিলিয়ান আচ্ছন্ন হয়ে গেল। তার মনে হলো— ভয়ঙ্কর কোনো বিপদ ঘটতে যাচ্ছে। তাহের কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়াবহ কোনো বিপদে পড়বে। লিলিয়ান যন্ত্রের মতো পরপর তিনবার বললে, Oh God! Save him Please, Save him… পরম করুণাময় ঈশ্বর। তুমি আমার স্বামীকে রক্ষা কর।
লিলিয়ানের সামনে রাখা হারিকেন নিভে গেল। সে স্পষ্ট শুনল খুব হালকা পায়ে কে যেন আসছে তার ঘরের দিকে। যে আসছে তার পা ছোট ছোট, সে পা ফেলছে খুব সাবধানে। দরজার কাছে এসে সে থমকে দাঁড়িয়েছে, এক হাতে দরজা ধরেছে তা বুঝা যাচ্ছে। দরজায় ক্যাচর্ক্যাচ শব্দ হলো। এর উপস্থিতিই কি লিলিয়ান টের পাচ্ছিল? কে, এ কে? লিলিয়ান আতঙ্কে অস্থির হয়ে কাঁপা গলায় বলল, কে? কে? Who is there?
ছোট্ট করে কে যেন নিঃশ্বাস ফেলল। ছোট নিঃশ্বাস, কিন্তু লিলিয়ান স্পষ্ট শুনল। সে কি তার নিজের নিঃশ্বাসের শব্দই শুনেছে? ভয় পেলে মানুষের মস্তিষ্ক ঠিক কাজ করে না। তারও কি তাই হয়েছে? ডা. ভারমান নিশ্চয়ই এর চমৎকার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। কিন্তু তার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই।
তাহের সিগারেট ধরিয়েছে। বর্ষাকাল হলেও কয়েকদিন বৃষ্টি না হওয়ায় রাস্তাঘাট শুকনো। একজন যাচ্ছে সামনে সামনে। তার হাতে টর্চলাইট। সে টর্চের আলো ফেলছে। তাহেরের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে চারজন যুবক। একজনের নাম তাহের জানেছালাম। চাচার মেজো ছেলে। সে আসছে সবার পেছনে। বাকি তিনজন কে? এরা সঙ্গে যাচ্ছে কেন? কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। ওরাও কিছু বলছে না। চাচার এমন কী জরুরি কথা থাকতে পারে? জমিজমা সম্পর্কিত কিছু? তাহেরের পৈতৃক জমি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। যা হবার হবে। এগুলি হাতছাড়া হয়ে একদিকে ভালো হয়েছে। বন্ধনমুক্ত হওয়া গেছে। জমির কারণে তার বাবাকে অপঘাতে মরতে হয়েছে। এই অভিশাপ থেকে তাহের মুক্তি চায়। তবে বাড়িটা সে রাখবে। সংস্কার করাবে। লিলিয়ানের যখন এত পছন্দ। তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হলে এদের দেখাতে নিয়ে আসবে। কে জানে বৃদ্ধ বয়সে সে নিজেও হয়তো ফিরে আসবে। সে এবং লিলিয়ান জীবনের শেষ সময়টা কাটাবে নদীর ধারের এই বিশাল বাড়িতে। ততদিনে গ্রামে গ্রামে ইলেকট্রিসিটিও নিশ্চয়ই চলে আসবে।
দলটা নদীর পাড়ে এসে থমকে দাঁড়াল। তাহের বলল, এখানে কী? টর্চ হাতের ছেলেটা বলল, নদীর হেই পাড়ে যাওয়া লাগব।
তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, নদীর ঐ পাড়ে কেন? ঐ পাড়ে কী? ছালাম তুমি এদিকে এসো। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
ছালাম এলো না। সে দ্রুত সরে গেল। গেল নদীর দিকেই। সেখানে ঝাঁকড়া একটা পাকুর গাছ। পাকুর গাছের ডালের সঙ্গে নৌকা বাধা। চাঁদ উঠে নি। চারদিক অন্ধকার। নক্ষত্রের আলোয় কিছু দেখা যাচ্ছে না। অসংখ্য বিঝি পোকা ডাকছে। Something is very wrong, তাহের দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করছে। চারজন যুবক তাকে ঘিরে আছে কেন? এরা নদীর পাড়ে তাকে নিয়ে এসেছে কেন? হত্যা করতে চায়? কোন চায়? টাকা-পয়সার জন্যে? মানুষ খুন করা এত সহজ।
টর্চ হাতের লোকটা বলল, আসেন নৌকায় আসেন।
তাহের কি দৌড়ে পালিয়ে যাবাব চেষ্টা করবে? পারবে পালাতে? এমনও তো হতে পাবে পুবো ব্যাপাধটা কিছুই না। সে ভয। পাচ্ছে বলেই আজেবাজে চিন্তা করছে। হয়তো তার চাচা নদীর ঐ পারে আরেকটা বাড়ি করেছেন। এই ছেলেগুলিকে রাখা হয়েছে বাড়ি পাহারার জন্যে।