তাহের আবার ডাকল, লিলিয়ান। এবার বোধহয় সে জেগে উঠেছে। লিলিয়ান ক্লান্ত গলায় বলল, কী?
পানি খাব।
আনছি।
পানির গ্লাস নিয়ে লিলিয়ান আবার শোবার ঘরে চলে এলো। তাহেরের গায়ে হাত রেখে মনে মনে বলল, I love you… যদিও মনে মনে বলার প্রয়োজন ছিল না। তাহের ঘুমিয়ে আছে। এই বাক্যটি শব্দ করেও বলা যেত। তবু কিছু কিছু কথা আছে মনে মনে বুলতেই ভালো লাগে।
খুব ভোরে পাখির কিচকিচি শব্দে
খুব ভোরে পাখির কিচকিচি শব্দে লিলিযানের ঘুম ভেঙেছে। এত পাখিকে সে একসঙ্গে কখনো ডাকতে শুনে নি। তাহেরকে ডেকে তুলে পাখির গান শোনাতে ইচ্ছা করছে। ডেকে লাভ হবে না। এত ভোবে সে উঠবে না। ছুটিব দিনে নটা-দশটার আগে তার ঘুম ভাঙে না। এখন তো প্রতিদিনই ছুটি। লিলিয়ান বিছানা ছেড়ে বাগানে গেল। কাল বাতে যে বাগানটাকে ভয়াবহ জঙ্গল বলে মনে হচ্ছিল এখন তা মনে হচ্ছে না। ঝোপঝাড় ঠিকই আছে, ঝোপঝাড়েবা জন্যেই ভালো লাগছে। বাগানটা বেশ বড়, বেশির ভাগ গাছই তার অচেনা। তাহেরের কাছ থেকে গাছের নামগুলি জেনে নিতে হবে। একটা বড় গাছেব সামনে লিলিয়ান থমকে দাঁড়াল। এ গাছটা চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে ওলিভ গাছ। এ দেশে কি ওলিভ গাছ হয়? একেক দেশে একেক রকম গাছ, সেই হিসেবে মানুষেবাও তো একেক রকম হওযা উচিত। এ বিষয়ে তাহেরের মতামত কী জিজ্ঞেস করতে হবে।
একটা গাছের নিচটা বাঁধানো। এখানে বসে, ব্রেকফার্স্ট খেলে কেমন হয়? তাহেরকে বললে সে হয়তো আবার মুখ বাকিয়ে বলবে–তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছি।
লিলিয়ানের ধারণা, সে মোটেই বাড়াবাড়ি করছে না। এই যে বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা কি বাড়াবাড়ি? নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি না। সে দেখছে মোট কত ধরনের গাছ। এখানে আছে।
ইস্কান্দর আলীর সঙ্গে বাগানেই লিলিয়ানের দেখা হলো। তিনি সকালের নাস্তা নিয়ে এদিকে আসছেন। এক হাতে টিফিন ক্যারিয়ার, অন্য হাতে ফ্লাস্ক। লিলিয়ানকে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। লিলিয়ান বলল, গুড মর্নিং!
তিনি হাসিমুখে মাথা নাড়লেন। লিলিয়ান বাংলায় থেমে থেমে বলল, আপনি কেমন আছেন?
ইস্কান্দর আলী থতমত খেয়ে বললেন, জ্বে ভালো। এইখানে কী করেন?
আমি বাগান দেখছি।
বাগানে দেখার কিছু নাই। সাপের আড্ডা। প্রতি বছর একটা-দুইটা গরু মরে। সাপ চিনেন তো?
জ্বি, আমি সাপ চিনি।
বড়ই ভয়ঙ্কর জিনিস। চলেন উপরে যাই। নাশতা নিয়া আসছি। খিচুড়ি আর ডিমের তরকারি। গৈ-গোরাম জায়গা। কিছু পাওয়া যায় না। সব জিনিস শহর থাইক্যা আনা লাগে। অনেক খরচ পড়ে।
লিলিয়ান সব কথা বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করছে–এই মানুষটি বলছে, শহর থেকে জিনিস আনতে হয় বলে টাকা বেশি লাগে। লিলিয়ান বলল, আপনি তাহেরকে বলবেন, ও টাকা দেবে।
বলতেও শরম লাগে। কত টেকা সে আনছে কিছুই তো জানি না।
ও যথেষ্ট টাকা-পয়সা এনেছে। আমরা বাড়িঘর ঠিক করব, টাকা লাগবে।
বাড়িঘর ঠিক কইরা ফয়দা কী? কে থাকব?
আমলা থাকব। আচ্ছা, আপনি বলুন তো এই গাছটার কী নাম?
জলপাই গাছ।
আমি ঠিক করেছি আমি এবং তাহের এই গাছের নিচে বসে সকালের ব্রেকফার্স্ট করব। কাউকে দিয়ে কি পরিষ্কার করিয়ে দিতে পারবেন?
পারব। কিছু খরচ-বরচ লাগবে। টেকা ছাড়া কাউবে দিয়া কিছু করন যায় না। যে যুগের যে ভাও। দুনিয়া গেছে উল্টাইয়া।
লিলিয়ান ইস্কান্দর আলীকে নিয়ে বাগানে ঘুরছে। গাছের নাম জিজ্ঞেস করছে। অনেকগুলি নাম লিলিয়ান শিখে ফেলল–আমগাছ, তেঁতুলগাছ, বেলগাছ, কাঁঠালগাছ, জলপাইগাছ, গাবগাছ… ।
লিলিয়ানের খুব ভালো লাগছে। তাহেরের ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত সে বাগানে বাগানে ঘুরল।
তাহের নাশতা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। দুপুরেব খাবার খেয়েও ঘুমুতে গেল। তার ঘুম ভাঙল বিকেলে। সে হাসিমুখে বলল, ইচ্ছা করে ঘুম স্টক করে নিয়েছি। আজ রাত জাগাব। তোমাকে নিয়ে ছাদে বসে থাকব। কাল ছাদে যাওয়া হয় নি। আজ হবে। ছাদটা সুন্দর। ছাদ থেকে ব্ৰহ্মপুত্র পরিষ্কার দেখা যায়। ব্ৰহ্মপুত্র নদীতে নৌকাভ্রমণ করতে চাও?
চাই।
দেখি খোঁজ করে।
তাহের হাই তুলতে তুলতে বলল, বেশি ঘুমানোর প্রবলেম কী জানো? নেশা লেগে যায়। তখন শুধু ঘুমুতে ইচ্ছা করে।
তুমি কি আবার ঘুমুবে?
না।
বাগানে যাবে? চল বাগানে যাই। বিকেলের চাটা বাগানে বসে খাই।
ওরে সর্বনাশ! বিকেলে বাগানে যাওয়াই যাবে না। বিকেলে সাপরা খুব উত্তেজিত থাকে। বিকেলে দোতলা থেকে নিচে নামাটা হবে চরম বোকামি। বরং চল ছাদে বসে চা খাই।
বেশ চল।
তোমাকে আরেকটা কথা বলা দরকার। আজ রােতই কিন্তু এ বাড়িতে আমাদের শেষ রজনী। কাল ভোরে আমরা চলে যাব। তোমার যা দেখার দেখে নাও। ছবি তুলতে চাইলে ছবি তোল। ক্যামেরাটা বের কর তো?
লিলিয়ানের মন খারাপ হয়ে গেল। আজই শেষ রজনী? লিলিয়ান কিছু বলল না। ছবি তোলার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ দেখা গেল না।
বিকেলে ছাদে। চা খাওয়া হলো না। কারণ ছাদের দরজার চাবি নেই। ছালাম চাবি নিয়ে এলো অনেক রাতে। সেই চাবিতে তালা না খোলায় তালা ভাঙতে হলো। ছাদে পাটি পেতে বিছানা করতে করতে রাত দশটার মতো বেজে গেল। লিলিয়ানের খুব শখ ছিল শাড়ি পরবে। শাড়ি জোগাড় হয় নি। সে তার সবচে সুন্দর ড্রেসটি পরে ছাদে বসে আছে। তাহের ছালামকে বিদেয় করে ছাদে আসবে। সে আসতে খুব দেরি করছে। একা একা ছাদে পসে থাকতে লিলিয়ানের খুব খারাপ লাগছে না। বরং ভালোই লাগছে। তবে আজ গত রাতের মতো জোছনা হয় নি। আকাশে মেঘ। মরা জোছনা।