বলতে চাচ্ছি না। বললে তুমি লজ্জা পাবে।
আমি লজ্জা পাব না। তুমি বলো। আমার শুনতে ইচ্ছে করছে।
তোমার শুনতে ইচ্ছা করলেও, আমার বলতে ইচ্ছা করছে না। আমার ঘুমুতে ইচ্ছা! করছে। আমি কি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে পারি?
হ্যাঁ পার। আমি সারারাত কিন্তু এখানেই বসে থাকব! তুমি এইভাবেই ঘুমুবে।
তোমার মধ্যে পাগলামির বীজ আছে লিলিয়ান। আমার ধারণা বেশ ভালো মতো আছে।
লিলিয়ান হালকা গলায় বলল, হয়তো আছে। এই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছে কী জানো? আমার মনে হচ্ছে এই যে–তুমি আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছএকজন কেউ তা দেখছে। খুব আনন্দ নিয়ে দেখছে।
সেই একজন কেউটা কে? ভূত-প্ৰেত?
বুঝতে পারছি না, তবে তার উপস্থিতি অনুভব করছি।
এ বাড়িতে তোমাকে বেশিদিন রাখা ঠিক হবে না। তোমার ব্ৰেইন পুরোপুরি নষ্ট হবার আগেই আমাদের চলে যেতে হবে।
ছালাম উঠে এসেছে। তাহের লিলিয়ানোবা কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে দেখেও সে অস্বস্তি বা লজ্জা কোনোটাই বোধ করল না। শুকনো গলায় তাহেরকে বলল, প্যাটারি আনছি।
তাহের তাকিয়ে দেখল। ছালাম দুটি পেনসিল ব্যাটারি নিয়ে এসেছে। তাহেরের কেন জানি মনে হলো সে এটা নিবুদ্ধিতার কারণে করে নি। ইচ্ছা করে করেছে।
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও।
আর কিছু লাগব?
না, আর কিছু লাগবে না।
লিলিয়ান বলল, আজ হঠাৎ তুমি এত গুছিয়ে কথা বলছ কেন? এত লজিক দিয়ে তুমি কখনো কথা বলো না।
তা বলি না, আজ বলছি। কারণ স্মামাব মনে হচ্ছে তোমার নিজস্ব জগতে লজিকের স্থান খুব কম। তোমার লজিক ভালো থাকলে কখনো আমাকে বিয়ে করতে না। আর কবলেও ভালো মতো খোঁজখবর করতে–আমি কে? আমার বাবা-মা কোথাব্য, কভাই বোন… ? কোনো প্রশ্ন না, কোনো কৌতুহান না–স্বপ্নে পাওয়া মানুষের মতো বলে বসলে–আমি আমার জীবনটা তোমার সঙ্গে কাটাতে চাই।
আমি কি ভুল করেছি?
তুমি ভুল করেছ কি-না তা আমি এই মুহূর্তে বলতে পারব না। তুমি নিজেও বুঝবে না। আজ থেকে দশ বা পনের বছর পর ধরতে পারবে।
কীভাবে ধরব?
আমাকে বিয়ে করার সময়, আমার সম্পর্কে তোমার কিছু প্ৰত্যাশা ছিল। আমি যদি তা মেটাতে পারি তাহলে বুঝতে হবে আমাকে বিয়ে করে তুমি ভুল কর নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি নিজে এখনো জানি না কোন প্ৰত্যাশা নিয়ে তুমি আমাকে বিয়ে করেছি। জানলে মেটাবার চেষ্টা করতাম।
তোমার প্রতি আমার কোনো প্ৰত্যাশা নেই। আমাকে তোমার পাশে থাকতে হবেএটা হলো নিয়তি।
তাহের সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, নিয়তি হচ্ছে আরেকটা বাজে কথা। যারা দুর্বল মানুষ, অর্থাৎ যারা দুর্বল লজিকের মানুষ–নিয়তি তাদের একটি প্রিয় শব্দ। এই শব্দ আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত। অভিধান থেকে এই শব্দ তুলে দেওয়া উচিত।
লিলিয়ান কোমল গলায় বলল, পৃথিবীর সব ভাষার অভিধানে কিন্তু এই শব্দটি আছে। নিয়তি বলে কিছু একটা আছে বলেই আছে।
তাহের রাগী গলায় বলল, তুমি একটা হাস্যকর লজিক দিলে লিলিয়ান। অভিধানে দৈত্য শব্দটাও আছে। পরী আছে, ড্রাগন আছে, মৎস্যকন্যা আছে। তুমি কি কখনো দৈত্য, পরী বা ড্রাগন দেখেছ? পৃথিবীর কেউ কি দেখেছে?
না, দেখে নি। এত রেগে যাচ্ছ কেন? চল ঘুমুতে যাই।
তাহের মুখে বলছিল তার ঘুম ছুটে গেছে, বাস্তবে দেখা গেল বিছানায় শোয়ামাত্র তার নাক ডাকতে শুরু করেছে। হারিকেন নিভিয়ে লিলিয়ান এসে পাশে শুয়েছে। তার ঘুম আসছে না। জানালা গলে জোছনা এসে পড়েছে তাদের খাটের এক মাথায়। কী সুন্দর যে লাগছে দেখতে! বাইরের বাগানে পাখি ডাকছে। লিলিয়ান কোন বইয়ে যেন পড়েছিল রাতে কখনো পাখি ডাকে না। বইয়ের তথ্য ঠিক না–অনেক পাখিই ডাকছে। বিবির ডাকের সঙ্গেও বোধহয় পাখিব ডাকের এক ধরনের সম্পর্ক আছে। বিঝিব ডাক যখন থামছে তখনই শুধু পাখি ডাকছে। ঝিঝি এবং পাখি কখনোই এক সঙ্গে ডাকছে না।
শোবার ঘরের দরজায় খুঁট করে শব্দ হলো। কে যেন দরজায় হাত বেখেছে। এ ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা যায় নি। দরজার ছিটিকিনিতে জং পড়েছে। কিছুতেই নড়ানো যায় না। কেউ যদি সত্যি সত্যি এসে থাকে। সে অল্প ধাক্কা দিয়েই দরজা খুলতে পারবে। আশ্চর্য তো, দরজা খুলে যাচ্ছে। লিলিয়ান তাহেরের গায়ে হাত রাখল। তাহের ঘুমের মধ্যেই বলল, আহ, কী কর!
লিলিয়ান হাত সরিয়ে নিল। সে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে দরজার ওপাশে কেউ একজন আছে। সে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছে। লিলিয়ান বলল, কে?
ফিসফিস কবে কেউ কি জবাব দিল? খুব হালকা স্বর যা বাতাসে ভেসে চলে যায়। লিলিয়ান খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামল। এগুলো দরজার দিকে। তার মোটেও ভয় করছে না। বরং ভালো লাগছে।
না, দরজার ওপাশে কেউ নেই। ফাঁকা সিঁড়ি। রেলিং গলে জোছনা পড়ে অপূর্ব সব নকশা তৈরি হয়েছে। নকশার ভেতর দিয়ে হাঁটতে কেমন লাগবে? লিলিয়ান হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে সে আয়নাঘরের সামনে চলে এলো। আয়নাঘরের দরজা ভেজানো। তার ইচ্ছা করতে লাগল ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে। ভেতরটা নিশ্চয়ই অন্ধকার। দরজা খুলে দিলে চাঁদের আলো কি ঘরে ঢুকবে?
লিলিয়ান দরজা খুলল। চাঁদের আলো ঘরে ঢুকেছে। আয়নার একটা অংশ আলোকিত হয়ে আছে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে! শোবার ঘর থেকে ঘুমের ঘোরে তাহের ডাকল, লিলিয়ান!
শোবার ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। আয়নাঘরের মেঝেতে পাটি পেতে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। পাটি ছাড়াও সিমেন্টের মেঝের উপর শুয়ে থাকা যায়। এ ঘরের মেঝে কালো সিমেন্টের। খুব মসৃণ। কেমন ঠাণ্ড ঠাণ্ডা ভাব।