আমি কি আপনাকে বিরক্ত করছ?
হ্যাঁ করছেন।
লোকটা চলে গেল, কিন্তু লিলিয়ানের মনে হলো সে আবার আসবে। সহজে তার সঙ্গ ছাড়বে না। এশিয়ান ছেলেগুলি মোটামুটি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে। সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সামান্যতম সুযোগও এরা ছাড়ে না। এও ছাড়বে না। চেষ্টা চালিয়েই যাবে। লোকটার সঙ্গে কথা বলাই উচিত হয় নি।
লিলিয়ানের অনুমান মিথ্যা হলো না। বিকেলে লিলিয়ানদের দলের সবাই বসে কফি খাচ্ছে। ছেলেটি উপস্থিত। লিলিয়ানের কাছে গিয়ে হাসিমুখে বলল, আমি আপনার জন্য একটা ফিল কিনে এনেছি।
লিলিয়ান কঠিন মুখে বলল, কেন?
আমার কারণে আপনার ফিল্ম নষ্ট হয়েছে। আমি প্রথম থেকেই লক্ষ করেছিলাম। আমার উচিত ছিল আপনাকে সতর্ক করা। তা করি নি, উল্টা মজা পেয়ে হেসেছি। অবশ্যই অপরাধ করেছি, কাজেই অপবাধের প্রায়শ্চিত্ত করছি।
লিলিয়ান কঠিন মুখে বলল, অপরাধ টপরাধ কিছু না। আপনি আমার সঙ্গে গল্প কবার লোভ সামলাতে পারছেন না। সুন্দবি অজুহাত বানিয়ে এগিয়ে এসেছেন।
আপনি ভুল বললেন। নিজেকে খুব রূপবতী ভাবছেন বলে এই সমস্যা হয়েছে। আপনি হয়তো আপনার দেশে, কিংবা খোদ এই আমেরিকাতেই রূপবতী। কিন্তু আমাদের দেশের রূপের বিচারে রূপবতী নন।
আপনাদের দেশে রূপবতী হবাব জন্য কি গায়েী রঙ আপনার মতো কুচকুচে কালো হতে হয়?
তা না। আমাদের দেশে রূপবতী মেয়েদের প্রথম শর্ত হলো–তাদের চোখ সুন্দর হতে হয়।
আমার চোখ সুন্দর না?
না। আপনার চোখের মণি নীল। আমাদের দেশে বাদামি বা নীল চোখের তারার মেয়েদের বলে বিড়াল-চোখা মেয়ে। এদের সহজে বর জুটে না। পুরুষরা এদের বিয়ে করতে চায় না।
কী অদ্ভুত কথা! আপনি কোন দেশের মানুষ?
দেশের নাম আপনাকে বলছি, কিন্তু দয়া করে দেশের নাম শুনে ঠোঁট উল্টে বলবেন না–এই দেশ আবার কোথায়? এ জাতীয় কথা যখন কেউ বলে অসম্ভব রাগ লাগে। আমার দেশের নাম বাংলাদেশ। নাম শুনেছেন?
না।
নাম না শোনার অপরাধ আমি ক্ষমা করলাম, যদিও ক্ষমা করা উচিত হচ্ছে না। যাই হোক, আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি?
বিড়াল-চোখা মেয়ের পাশে বসে কী করবেন?
আপনার সঙ্গে এক কাপ কফি খাব, তারপর চলে যাব।
বসুন।
আপনার নাম কি জানতে পারি?
লিলিয়ান গ্রে।
আমার নিজের নামটা কি আপনাকে বলতে পারি?
লিলিয়ান চুপ করে রইল। মানুষটার সাহস দেখে সে বিস্মিত হচ্ছে। লোকটা হাসিমুখে বলল, আমার নাম তাহের। আপনি যেমন লিলিয়ান গ্রে, তেমনি গায়ের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে আমাকে তাহের ব্ল্যাক বলে ডাকা যায়। আমি সম্প্রতি আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি পাস করেছি। আমার ফিন্ড অব স্পেশালাইজেশন হচ্ছেচোখ। আমি ডাক্তারি পড়ছি, ভবিষ্যতে চোখের ডাক্তার হবো।
ভালো।
চোখের ডাক্তার হিসেবে আপনার নীল চোখ সম্পর্কে আমি আপনাকে মজার একটা তথ্য দিতে পারি। তথ্যটা হচ্ছে–বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আপনার চোখ কিন্তু কালো হতে থাকবে, নীল থাকবে না।
কেন?
চোখের পিগমেন্টগুলি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে। চোখের বঙ নির্ভর কবে পিগমেন্টের সাইজের ওপর। সাইজ বড় হলে রঙ কালো হয়ে যাবে। এক ধরনের Tyndall effect.
কখন চোখ কালো হবে?
যখন বুড়ো হবেন তখন।
আপনি বলতে চাচ্ছেন বৃদ্ধ বয়সে আমি যদি আপনার দেশে যাই তাহলে আমাকে সবাই রূপবতী বলবে?
তাহের হো-হো করে হাসতে লাগল। এমন হাসি যে লিলিয়ানদের দলের সবাই চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। লিলিয়ান নিজেও খানিকটা অপ্ৰস্তুত বোধ করতে লাগল। হাসতে হাসতে তাহেরের চোখে পানি এসে গেল। সে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, সরি। আমি একটু বেশি হাসি। আমার হাসি-রোগ আছে। একবার হাসতে শুরু কবলে থামতে পারি না। পুরো এক ঘণ্টা তেইশ মিনিট ক্রমাগত হাসার আমার একটা ব্যক্তিগত রেকর্ড আছে। গিনিস রেকর্ড কত তা অবশ্যি জানি না।
হাসি-রোগ ছাড়া আর কী রোগ আছে?
ঘুম-রোগ আছে।
ঘুম-রোগটা কী?
একবার ঘুমিয়ে পড়লে সহজে আমার ঘুম ভাঙে না।
খুব আনকমন রোগ কিন্তু না। অনেকেরই এই রোগ আছে।
আমারটা আনকমন। উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন। দুবছর আগে আমি লস এনজেলসে ছিলাম। হোস্টেলে থাকি। একবার ভূমিকম্প হলো। ভূমিকম্পের নিয়ম হচ্ছে প্রথম একটা ছোট দুলুনি হয়–তারপর হয় বড় দুলুনি। প্রথম দুলুনির পর আমার বন্ধুবান্ধবরা আমার ঘুম ভাঙানোর প্রাণপণ চেষ্টা করল। কোনো লাভ হলো না। শেষে ওরা আমাকে চ্যাংদোলা করে বাইরে নিয়ে ফুটপাতে শুইয়ে রাখল। আমার ঘুম ভেঙেছে ভোরে, জেগে দেখি আমি একটা হাইড্রেন্টের পাশে শুয়ে আছি।
লিলিয়ান খিলখিল করে হেসে উঠল। লিলিয়ানের সঙ্গীরা আবারো ফিরে তাকাল। তাহের বলল, আমরা বোধহয় ওদের ডিস্টার্ব করছি, একটু দূরে গেলে কেমন হয়?
ভালো হয় না। আমাদের যাত্রার সময় হয়ে গেছে। আমি এখন উঠব।
আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। আমি আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি।
ধন্যবাদ। অপরিচিত কারো গাড়িতে আমি চড়ি না।
শুরুতে অপরিচিত ছিলাম। এখন নিশ্চয়ই অপরিচিত না। আপনি আমার নাম জানেন। আমি আপনার নাম জানি।
লিলিয়ান কঠিন মুখে বলল, আপনি শুধু শুধু আমার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছেন। আপনার গাড়িতে আমি যাব না।
লিলিয়ান তার সঙ্গীদের দিকে রওনা হলো। একবার তার ইচ্ছা করল পেছন ফিরে মানুষটির মুখের বিব্ৰত ভঙ্গিটা দেখে। অনেক কষ্টে এই লোভ সে সামলাল। মনে মনে ভাবল–ভালো শিক্ষা হয়েছে। কাউকে শিক্ষা দেবার এটাই সবচে ভালো টেকনিক। প্রথম কিছুটা প্রশ্ৰয় দিতে হয়, তারপর ছুঁড়ে ফেলতে হয় আঁস্তাকুড়ে। আশ্চর্য স্পর্ধাফিল্ম কিনে নিয়ে এসেছে। আড়াই ডলার দামের একটা উপহাব কিনে মনে মনে ভেবেছে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।