তাহের চা খাচ্ছে। কাচের গ্লাসে চা দেয়া হয়েছে। গ্লাস গবাম হয়ে গেছে–চা খাওয়া যাচ্ছে না। তাহের চায়ের গ্লাসে ফুঁ দিতে দিতে বলল, আমার মাব। ধাবণ উনি একবার তিতিলী বেগমকে দেখেছিলেন।
উনি দেখবেন কীভাবে?
মার ধারণা, দেখেছেন। গভীর রাতে আয়নাঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন, হঠাৎ শুনেন আয়নাঘরের ভেতর থেকে ঝুনঝুন চুড়ির শব্দ। আয়নাঘর তালাবন্ধ। চুড়ির শব্দ কীভাবে আসবে? মা খুব অবাক হলেন। উনার সাহসের সীমা ছিল না। চাবি নিয়ে আয়নাঘর খুললেন। মোমবাতি হাতে একা একা আয়নাঘরে ঢুকলেন।
তারপর?
তারপরের ব্যাপার পরিষ্কার জানা যায় না। মা কিছু একটা দেখেছিলেন। কী দেখেছিলেন কিছুই ভেঙে বলেন নি। এরপর থেকে তার অভ্যাস হয়ে গেল।–গভীর রাতে আয়নাঘরের দরজা খুলে সেখানে ঢুকতেন। অনেকক্ষণ থাকতেন। আয়নাঘরের মেঝেতে পাটি পেতে দুপুরে ঘুমুতেন। আমার বাবা জানতে পেরে খুব রাগ করেন। বাবার ধারণা, এই বাড়িটা অভিশপ্ত। এ বাড়িতে থাকলে অকল্যাণ ছাড়া কল্যাণ হবে না। তিনি মাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
কোথায় যান?
প্রথম ময়মনসিংহ শহরে যান। সেখান থেকে যান ঢাকায়। ঢাকায় যাবার পর থেকে মার মাথায় পাগলামি ভর করে। তিনি রাতে একেবারেই ঘুমুতেন না। ছটফট করতেন। আর বলতেন— ঐ বাড়ি ফেলে এসেছি, উনি খুব রাগ করছেন। খুব মন খারাপ করছেন। উনার কত শখ বাড়ি ভর্তি থাকবে ছেলেমেয়েতে। তারা হৈচৈ করবে, চেঁচামেচি করবে।
উনি মানে কে? তিতালী বেগম?
হুঁ। মা খুব কান্নাকাটি শুরু করেন বাড়ি যাবার জন্য। বাবা পাত্তাই দেন নি। বাবা বলতেন–ঐ বাড়িতে থাকার জন্যেই তোমার মাথার দোষ হয়েছে। আমি ওখানে তোমাকে নিয়ে যাব না। বাবা নিয়ে যান নি। মার মৃত্যু হয় ঢাকায়।
তোমার কি মনে হয় না তোমার বাবা ভুল করেছিলেন?
না, মনে হয় না। বাবা যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন। মাব মনের ভ্রান্তিকে তিনি আমল দেন নি। তুমি নিশ্চয়ই মনে কর না আয়নাঘরে একজন মৃত মানুষ বাস করে।
জগৎ বড়ই রহস্যময় তাহের।
জগৎ মোটেই রহস্যময় নয়। জগৎ কঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলায় বাঁধা। প্রকৃতি কখনো কোনো নিয়মের ব্যতিক্রম হতে দেয় না। রহস্যের বাস মানুষের মনে। মানুষই রহস্য লালন করে। যেমন তুমি কর। কত আয়োজন করে জোছনা দেখলে। জোছনার যে সৌন্দর্য তার সবটাই তুমি আরোপ কবেছ। জোছনা কী? সূর্যের প্রতিফলিত আলোএকে নিয়ে মাতামাতি করার কিছু নেই। কিন্তু তুমি মাতামাতি কবিছ। তোমার মতো অনেকেই করছে। কবিতা লেখা হচ্ছে। গান লেখা হচ্ছে–আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে… ।
লিলিয়ান বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। ছালাম সব কাজ ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লিলিয়ানের দিকে। লিলিয়ান বাংলায় বলল, আপনাদের পাঠানো খাবার উত্তম হয়েছে। পান খুবই উত্তম হয়েছে। ছালাম কিছু বলছে না। তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে লিলিয়ানের কোনো কথা তার কান দিয়ে ঢুকছে না। লিলিয়ান বলল, আমি আমাদের এই বাগান প্ৰাতঃকালে পরিচ্ছন্ন করব। আমি কিছু লেবার নিয়োগ করব। দয়া করে আমাকে সাহায্য করবেন। আপনি কি আমার বাংলা ভাষা বুঝতে পারছেন?
ছালাম কিছু বলল না। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। তাহের বলল, বিদেশী উচ্চারণে তোমার অদ্ভুত বাংলা সে কিছুই বুঝে নি। বোঝাব চেষ্টাও করে নি। আমিই বুঝতে পারি না, আর বুঝবে ছালাম আলী! সে হা করে তাকিয়ে ছিল তোমার দিকে। যাই হোক, এসে বসো এখানে। জোছনা দেখ।
লিলিয়ান বসল। তাহের হাই তুলতে তুলতে বলল, কাঁপাচিনো কফি খেতে পারলে ভালো হতো। যা ঘুম পাচ্ছে বলার না। চাঁদটাকে ঘুমের ট্যাবলেটের মতো লাগছে। যতই দেখছি ততই ঘুম পাচ্ছে। ভালো কথা, জঙ্গল পরিষ্কারের কথা কী বলছ? এইসব মাথা থেকে দূর করা।
না, দূর করব না। আমি বাগান পরিষ্কার করব। বাড়ি ঠিকঠাক করব। আমাদের এত সুন্দর বাড়ি এভাবে পড়ে থাকবে?
সুন্দর দেখলে কোথায়?
আমার কাছে খুব সুন্দর লাগছে।
আচ্ছা ধরে নিলাম সুন্দর। কে থাকবে তোমার এই সুন্দর বাড়িতে?
আমরা দুজন থাকব। আমাদের ছেলেমেয়েরা থাকবে। এরা বাগানে খেলবে। আমি এদের জন্যে দোলনা বানিয়ে দেব। জোছনা রাতে বাচ্চাদের হাত ধরে আমরা নদীর পারে। হাঁটব। আর একটা বড় নৌকা কিনব। নদীর ঘাটে নৌকা বাধা থাকবে।
তাহের হাসতে হাসতে বলল, কী বলছি পাগলের মতো?
আমার মনের ইচ্ছার কথা তোমাকে বলছি।
লোকালয় ছেড়ে আমরা বনে পড়ে থাকব?
হ্যাঁ।
তোমার কী হয়েছে বলো তো লিলিয়ান?
বুঝতে পারছি না।
আমার মনে হয় ঘুমের অভাবে তোমার চিন্তাশক্তি এলোমেলো হয়ে গেছে। ভালো করে ঘুমাও–দেখবে মাথা থেকে ভূত নেমে গেছে। চল শুয়ে পড়ি।
তুমি শুয়ে পড়। আমি খানিকক্ষগ বসি।
আচ্ছা বসো, আমি তাহলে এখানেই শুয়ে থাকি। তোমার যখন জোছনা দেখা শেষ হবে, আমাকে ডেকে দিও।
একটুক্ষণ জেগে থাক না। আমার খুব গল্প করতে ইচ্ছা করছে।
তাহের হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি জেগে থাকার চেষ্টা করছি। তুমি গল্প শুরু কর। আমার পক্ষে গল্প করা সম্ভব না। আমার পক্ষে যা সম্ভব তা হচ্ছে হাই তোলা। ঐ কাজটা আমি দায়িত্বের সঙ্গে করে যাচ্ছি।
তাহের দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। মনে হচ্ছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
লিলিয়ান গলার স্বর হঠাৎ অনেকখানি নিচে নামিয়ে বলল, আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসি তা কি তুমি জানো?
তাহের চোখ না মেলেই বলল, জানি।
কীভাবে জানো?