তুমি যাও। আমি এই ঘরে একটু একা একা থাকি।
কেন বলে তো?
দিচ্ছে–দেখ, দেখ।
তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, হ্যাঁ দেখলাম। কারণটা কী?
প্ৰায় দেড়শ বছর আগে এই বাড়ির বউ এক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেছিল। আজ আমি নিজেকে দেখছি। আমিও এই বাড়িরই বউ। এই আয়নাটা আমার।
তাহের বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। লিলিয়ান বলল, আমি যখন অসুস্থ হয়ে পড়ব তখন তুমি আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসবে। আমি চাই আমার মৃত্যু যেন আয়নাঘরে হয়।
সে তো অনেক দূরের ব্যাপার। আপাতত ভাত খাই চল।
প্লিজ, প্লিজ, আমি খানিকক্ষণ এখানে একা থাকব। খুব অল্প কিছুক্ষণ।
তাহের চিন্তিতমুখে বের হয়ে এলো। লিলিয়ান তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে। তাহের লিলিয়ানের কাণ্ডকারখানা কিছুই বুঝতে পারছে না।
রান্নার আয়োজন ভালো। রুই মাছ ভাজা। পোলাও কোরমা। এক বাটি পায়েস। লিলিয়ানের জন্যে একটা কাটা চামচও দেয়া হয়েছে। তবে পোলাও সিদ্ধ হয় নি–চাল চাল রয়ে গেছে। কোরমা রান্না হয়েছে প্রচুর পরিমাণে চিনি দিয়ে। খেতে রসগোল্লার মতো লাগছে। তাহের বিরক্তমুখে বলল, ভাজা মাছ খেয়ো না লিলিয়ান। মাছটা পচা বলে ভেজে ফেলেছে।
খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে পানটাই আরাম করে খাওয়া গেল। মীেবী দিয়ে সুন্দর করে বানানো। লিলিয়ান দুটা পান মুখে দিল। সে বিস্মিত হয়ে বলল, খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে তোমরা ভেজিটেবল খাও কেন তা তো বুঝলাম না।
তাহের বলল, এটা ভেজিটেবল না। এর নাম পান। খাবার পর খেতে হয়। কুৎ করে গিলে ফেললে হবে না। ক্রমাগত চিবিয়ে যাবে। গিলতে পারবে না।
কতক্ষণ চিবাবো?
আধঘণ্টা তো বটেই।
তাতে লাভ কী?
মুখের একটা একসারসাইজ হয়। এইটুকুই লাভ।
ঠাট্টা করছ?
মোটেই ঠাট্টা করছি না। তুমি কি ভেবেছ আমার কাজ শুধু ঠাট্টা করা?
জিনিসটা খেতে আমার ভালো লাগছে।
ভালো লাগলে খাও। আমাদের গ্রামের নতুন বউদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের একটি হচ্ছে পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা।
আমি তো নতুন বউ না।
অবশ্যই নতুন বৌ। ছেলেমেয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমাদের দেশের বউদের নতুন বউ ধরা হয়।
কোনো মহিলার দশ বছরেও যদি ছেলেমেয়ে না হয় তাহলে কি তাকে নতুন বউ ধরা হবে?
না। তখন তাকে বলা হবে বাঁজা-মেয়েমানুষ। অমঙ্গলজনক একটি ব্যাপার। সেই মেয়েকে কোনো উৎসবে ডাকা হবে না। সকালবেলা কেউ তার মুখ দেখতে চাইবে না।
তোমাদের নিয়ম-কানুন ভারী অদ্ভুত।
অদ্ভুত তো বটেই। আরো অদ্ভুত কথা শুনবে? আমাদের দেশে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে পাশাপাশি বসে পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকাবে না।
তাকালে কী হয়?
তাকালে তাদের যে সন্তান হবে সে হবে চরিত্রহীন।
আবার তুমি তামাশা করছি। কী জন্যে করছ তাও বুঝতে পারছি। তুমি আমার সঙ্গে &জাছনা দেখতে চাচ্ছ না।
জোছনা দেখতে অসুবিধা নেই। চাঁদের দিকে না তাকালেই হলো।
ছাদে সত্যি সত্যি বসবে। আমার সঙ্গে?
হুঁ বসব। তবে ছাদে না। বারান্দায়। তোমার বিখ্যাত চাঁদ বারান্দা থেকেও দেখা যায়। চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি যদি মুগ্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি কিছু মনে কবো না। ঘুমিয়ে পড়ার সম্ভাবনা নিরানব্বই দশমিক নয় ভাগ।
ইস্কান্দর আলীর মেজো ছেলে বারান্দা ঝাঁট দিচ্ছে। তাহের তাকে বারান্দায় চাদর পাততে বলেছে। এই ছেলেই খাবার নিয়ে এসেছে। বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে এনেছে। তার বুদ্ধি কোন পর্যায়ের তাহের এখনো ধরতে পারছে না। সে টর্চ কিনে এনেছে, কিন্তু ব্যাটারি আনে নি।
তোমার নাম কী?
ছালাম।
ছালাম না। সালাম?
ছালাম। ছালাম আলী।
ছালাম তোমাকে টর্চের ব্যাটারি। আনতে যেতে হবে, পারবে না?
হুঁ।
দোকান কি অনেক দূর?
হুঁ।
দূর হলে থাক, সকালে এনে দিও।
ছাইকেল আছে।
সাইকেল থাকলে সাইকেলে করে নিয়ে এসো।
তারা ঘুমুতে গেল রাত দুটায়। তাহের বলল, হারিকেন জ্বালানো থাকুক। লিলিয়ান বলল, হারিকেন জ্বালানো থাকলে ঘরে চাঁদের আলো আসবে না। তাহের বলল, তোমার ভেতর এত কাব্যভাব আছে তা কিন্তু আমার জানা ছিল না।
জানা থাকলে কী করতে, আমাকে বিয়ে করতে না?
তাহের হাসল। হাসতে হাসতে বলল, চা খেতে ইচ্ছা করছে। আমার সমস্যা হচ্ছে ঘুমের প্রথম ধাক্কাটা কেটে গেলে ঘুম আসে না। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, বাকি রাতটা তুমি আরাম করে ঘুমুবে, আর আমাকে জেগে থেকে তোমার বিখ্যাত জোছনা দেখতে হবে।
চা সত্যি খেতে চাও? আমার কাছে টি-ব্যাগ আছে, সুগার কিউব আছে। শুধু দুধ নেই।
পানি গরম করবে। কীভাবে?
কাগজ জ্বলিয়ে পানি গরম করব।
কাগজ পাবে কোথায়?
তুমি ডার্টি জোকস-এর যে বইটি এনেছ, সেটা পুড়িয়ে ফেলব। বানাব চা?
মন্দ না। পারলে বানাও।
তুমি চুপচাপ বিছানায় বসে থাক। আমি চা বানিয়ে আনছি।
আমি তোমার পাশে বসি।
লিলিয়ান চায়ের পানি গরম করছে। পাশে বসে আছে তাহের। তার ঘুম কেটে গেছে বলে মনে হচ্ছে না। সে খানিকক্ষণ পরপর হাই তুলছে। লিলিয়ান বলল, তুমি ঐ মহিলা সম্পর্কে আরো কিছু বলে।
কোন মহিলা?
আয়নাঘরে যিনি মারা গিয়েছিলেন।
আমি কিছুই জানি না। খুব রূপবতী ছিলেন, এইটুকু জানি। জাঙ্গির মুনশি বেনারস থেকে একজন আর্টিস্ট এনে তার কিছু ছবি আঁকিয়েছিলেন। সেইসব ছবি দেখলে তার সম্পর্কে আন্দাজ পেতে। তবে ছবিও নেই। উনার মৃত্যুর পর জাঙ্গিব মুনশি তাঁর স্ত্রীর সব ছবি পুড়িয়ে ফেলেন।
লিলিয়ান কোমল গলায় বলল, উনাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।