লাখের বাতিটা কী?
আমাদের অঞ্চলে নিয়ম ছিল–কেউ লাখপতি হলে লাখের বাতি জ্বালাতে হতো। একটা লম্বা বাঁশের মাথায় হারিকেন জ্বলিয়ে ঘরের উঠানে রেখে দিত। এই হলো লাখের বাতি। দূর থেকে দেখে লোকজন বুঝত এই অঞ্চলে একজন লাখপতি আছে।
এই নিয়ম কি এখনো আছে?
পাগল হয়েছ? এই নিয়ম থাকলে উপায় আছে? আজ কোনো বাড়িতে লাখের বাতি জুলালে কালই ডাকাতি হবে। সেই বাড়িতে যদি তোমার মতো রূপবতী কেউ থাকে তাহলে তো কথাই নেই।
আমার মনে হয় এ বাড়িতে এসে তোমার ভালো লাগছে না।
এখন পর্যন্ত ভালো লাগার মতো কোনো কারণ ঘটে নি।
আমার কাছে কিন্তু অসাধারণ লাগছে।
ভাঙা বাড়ি অসাধারণ লাগছে?
পুরনো বাড়ি ভাঙা তো থাকবেই। এই অঞ্চলের জন্যে পুরনো বাড়ি সুন্দর মানিয়ে গেছে। ঝকঝকে নতুন বাড়ি এখানে মানাতো না। আমি এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাচ্ছি। আর গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে।
ভয়ে?
না ভয়ে না। মনে হচ্ছে এই ঘরগুলিতে কত না স্মৃতি, কত বহস্য–আমি ঠিক করেছি আজ। সারারাত ঘুমুব না।
হারিকেন হাতে এক ঘর থেকে আবেক ঘরে ঘুরবে?
হ্যাঁ।
খুব ভালো কথা। ঘুরে বেড়াও। দয়া করে আমাকে ঘুমুতে দিও। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে আছি। ডিনার শেষ হওয়া মাত্র শুয়ে পড়ব।
লিলিয়ান বলল, তুমি আমাকে ক্ৰমাগত মশার ভয় দেখিয়েছ। মশা কিন্তু নেই।
তাই দেখছি। তবে ঘুমুতে হবে মশারি খাটিয়ে। মশা না থাকুক, পোকামাকড় আছে।
আজ রাতে না ঘুমুলে কেমন হয়?
কী বললে?
চল আমরা বারান্দায় বসে জোছনা দেখি।
আর কোনো পরিকল্পনা আছে?
আমার খুব শাড়ি পরতে ইচ্ছা করছে। সুন্দর একটা শাড়ি জোগাড় করতে পারবে? আমাকে শিখিয়ে দেবে কী করে পরতে হয়?
তোমার কি মনে হয় না লিলিয়ান তুমি বাড়াবাড়ি করছ?
না, আমার মনে হয় না।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি বাড়াবাড়ি করছি।
লিলিয়ান কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার এরকম মনে হয়ে থাকলে আমি দুঃখিত। আমার যা মনে হয়েছে। আমি তোমাকে বলেছি। তোমাদের এই বাড়িটা ভাঙা। দরজা-জানালা লোকজন খুলে নিয়েছে। তারপরেও এ বাড়িতে পা দেয়ার পর থেকে আমার ভালো লাগছে। এক ধরনের আনন্দ অনুভব করছি। সেই আনন্দ লুকানোর চেষ্টা করি নি। হয়তো সেটা করাই উচিত ছিল।
লিলিয়ান বারান্দায় চলে গেল। তার খুব খারাপ লাগছে। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখলে তাহের হেসে উঠতে পারে। লিলিয়ান চোখের পানি দিয়ে তাহেরকে হাসাতে চায় না। লিলিয়ান একটা ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে লাগল। তার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে, ঘরগুলি তাকে ডেকে ডেকে বলছে, এসো লিলিয়ান, এসো। আমাকে দেখে যাও।
তাহের এসে লিলিয়ানকে আবিষ্কার করল সর্বদক্ষিণের বারান্দায়। এখান থেকেই লোহার সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে।
লিলিয়ান!
কী?
তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?
না।
মনে হচ্ছে তুমি রাগ করেছ। আসল ব্যাপার কী জানো, আমার চাচার সঙ্গে কথা বলে মেজাজ হয়েছে খারাপ। কিছুই ভালো লাগছিল না। এই কারণেই তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। কিছু মনে করো না।
আমি কিছু মনে করি নি।
খাওয়া-দাওয়াব পর আমরা ছাদে বসে জোছনা দেখব।
ছাদে উঠার সিঁড়ি আছে?
হ্যাঁ, সিড়ি আছে। তালাবন্ধ। চাচার ছেলেটাকে পাঠিয়েছি। চাবি আনতে।
থ্যাংক ইউ।
তোমার খিদে পেয়েছে লিলিয়ান?
এখনো খিদে পায় নি।
একটা বিরাট ভুল হয়েছে। ওদের বলে দেয়া উচিত ছিল মসলা কম দিতে। এরা প্রচুর মসলা দিয়ে রান্না করবে। ঝালের জন্যে কিছু মুখে দিতে পারবে না।
আমার খাওয়া নিয়ে ভেবো না। তুমি যা খেতে পারবে, আমিও পারব।
সব ঘর দেখা হয়েছে?
হ্যাঁ।
আয়নাঘর? আয়নাঘর দেখেছ?
না তো। আয়নাঘর কী?
ওটা একটা ইন্টারেস্টিং ঘর। আমার দাদার বাবা–দি গ্রেট জাঙ্গির মুনশি, এই ঘর বানিয়েছিলেন। তালাবন্ধ কি-না জানি না। তালাবন্ধ থাকার কথা। চল দেখি–খুঁজে বের করতে হবে–কোন দিকে তাও জানি না।
ঘরটা তালাবন্ধ। বেশ বড় তালা ঝুলছে। কয়েকবার ঝাঁকি দিতেই তালা খুলে গেল। অনেকদিন বন্ধ থাকায ঘরে ভ্যাপসা জলজ গন্ধ। ছোট্ট ঘর, কোনো জানালা নেই। ঘরে ঢোকার একটিই দরজা। সেই দরজা ও নিচু। ঘবেব একদিকের পুবো দেয়াল জুড়ে বিশাল আয়না। অন্য পাশে কাবার্ড।
লিলিয়ান বলল, এত বড় আয়না কোথায় পেলেন?
তাহের হাসতে হাসতে বলল, জানি না কোথায় পাওয়া গেছে। দি গ্রেট জাঙ্গির মুনশি জোগাড় করেছিলেন সাহেব বাড়ি থেকে। অর্থাৎ ইংরেজদের কাছ থেকে। এই ঘরটাব নাম হলো আয়নাঘব। জাঙ্গির মুনশির স্ত্রী তিতালী বেগম এই ঘরে সাজগোজ করতেন। সাজের সময় বাইরের কেউ যেন দেখতে না পায় এ জন্যেই এ-ঘরের কোনো জানালা নেই। লক্ষ করেছ?
হ্যাঁ, লক্ষ করেছি।
ঐ মহিলা অসম্ভব রূপবতী ছিলেন। তিনি তার একমাত্র পুত্রের জন্মদিনে মারা যান। মাত্র ষোল বছর বয়সে।
আহা।
আয়নাঘর উনার খুব প্রিয় ছিল। উনি যখন মোটামুটি নিশ্চিত হলেন যে মারা যাচ্ছেন তখন তিনি তার স্বামীকে বলেন তাকে আয়নাঘরে নিয়ে যেতে। তাই করা হলো। তিনি মারা গেলেন আয়নাঘরে। জঙ্গিব মুনশি দ্বিতীয়বার বিয়ে কবেন নি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি প্ৰায় চল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এই চল্লিশ বছর তিনি আয়নাঘর বন্ধ করে রেখেছিলেন। একদিনের জন্যেও খুলেন নি। উনার মৃত্যুর পর আয়নাঘর প্রথম খোলা হয়। এসো লিলিয়ান, খুব সম্ভব খাবার নিয়ে এসেছে। খেয়ে নেই। খিদে লেগেছে। তাছাড়া আমার বেশিক্ষণ থাকা ঠিকও নয়। আযানাঘরে কোনো পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ।