শুয়োরের গোশত খায়?
তাহের ক্ষিপ্ত গলায় বলল, খেলে কী কববেন? শুয়োরের গোশত ব্যবস্থা করবেন?
রাগ হও ক্যান? কথার কথা বললাম। তোমার ইসাতিরি দেখি হাসন্তাছে। সে বাং কথা বুঝে?
তাকেই জিজ্ঞেস করুন।
একলা একলা বাড়িতে ঢুকতেছে, তারে নিয়েধ করা।
নিষেধ করতে হবে না। তার বুদ্ধিাশুদ্ধি আছে।
লিলিয়ান হারিকেন হাতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠছে। মনে হচ্ছে এটা তার অনেকদিনের চেনা বাড়ি।
ইস্কান্দর আলী থু করে তাহেরের পায়ের কাছে একদলা থুথু ফেললেন। তাহের চমকে সরে গেল। ইস্কান্দর আলী হাই তুলতে তুলতে বললেন, খাওয়ার জইন্যে কিছু খরচ দিও। জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য। মাছ এক জিনিস পাওয়াই যায় না। একটা মুরগির বাচ্চা হেব দামই তোমার চল্লিশ, পঞ্চাশ।
তাহের দুটা পাঁচশ টাকার নোট বের করল। তিনি বিরসমুখে নোট দুটা হাতে নিলেন। তাহের বলল, উত্তর দিকে ভাঙা দেয়াল ঠিক করার জন্যে টাকা চেয়েছিলেন। পাঠিয়েছিলাম। দেয়াল তো ঠিক হয় নি।
বললেই ঠিক হয় না। ইট, সুরকি, সিমেন্ট আনাইতে হয় শহর থাইক্যা। বর্ষা মৌসুমে নৌক দিয়া আনতে হয়। বিরাট যন্ত্রণা।
টাকাটা কী করেছেন?
আছে, টাকা আলাদা করা আছে।
বাড়িটার এ কী অবস্থা! ভূতের বাড়ি বলে মনে হচ্ছে। আলোর কোনো ব্যবস্থা করেছেন?
দুইটা হারিকেন আছে। মোমবাতি আছে।
একটা টর্চের ব্যবস্থা করুন।
আইচ্ছা করব। বললেই তো হয় না। সব আনতে হয়। শহর থাইক্যা। তোমরারে একটা উপদেশ দেই,–দোতলায় থাকবা। একতলায় নামনের প্রয়োজন নাই।
কেন?
সাপের উপদ্রব। গত চইত মাসে সাপের কামড়ে একটা গরু, মারা গেল।
কার্বলিক এসিডেব ব্যবস্থা করতে পারবেন? এখানে কোনো ফার্মেসি আছে?
না। তুমি বললে ছেলে একটারে শহরে পাঠাইতে পারি। এরা কিছুই করে না। বাদাইম্যা হইছে। শহরে যাইতে বললে ফাল দিয়া উঠে।
দিন, কাউকে পাঠিয়ে দিন।
যাওনের খরচ দেও। আন কী আনা লাগব কাগজে লেইখ্যা দেও। সাপের ওষুধ?
ওষুধে কিছু হয় না–কপালে লেখা থাকলে ওষুধের বোতলের ভিতরে বসা থাকলেও সাপে কামরাইব।
আমি কাগজে লিখে দিচ্ছি। দয়া করে আনাবার ব্যবস্থা করুন। একশ টাকা দিচ্ছি। যাওয়ার খরচ। এতে হবে?
আরো কিছু দেও। একশ টেকা আইজ-কাইল কোনো টেকাই না। তুমি থাক বিদেশে। এই জন্যে বুঝতাছ না। আর একটা কথা, তোমার পরিবাররে নিয়া আমরার বাড়িত একদিন যাওয়া লাগে। বাড়ির মেয়েছেলেরা দেখতে চায়। এরা আবার কার কাছ থাইক্যা জানি হুঁনছে–বিলাতের মাইয়াছেলে পিসাব পায়খানার পরে পানি নেয় না। বড় ঘিন্নাকর, কিন্তু কী আর করা! যে দেশে যে নিয়ম! তোমার আমার কারণের কিছু নাই।
তাহের বিরক্তমুখে বলল, ঠিক আছে আপনি এখন যান। রাতে খাবার পাঠিয়ে দেবেন। খাবার পানি পাঠাবেন।
আইচ্ছা। তোমরা নিশ্চিত হইয়া ঘুমাও। ছেলে দুইটারে বইল্যা দিছি। রাইতে পাহারা দিতে। এরা কাজকাম কিছুই করে না। বাদাইম্যা। যে কয়দিন থাকবা এরা পাহারা দিব। কিছু খরচ-বরচ দিও।
তাহের দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
লিলিয়ান হারিকেন হাতে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। ইক্কান্দর আলী দোতলার জানালার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার ইসাতিরি বড়ই সৌন্দৰ্য। এইটা বিপদের কথা। ডাকাইতে সন্ধান পাইলে বড়ই খুশি হইব। ইস্কান্দর আলীর দুই ছেলেও গভীর আগ্রহ নিয়ে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে পলক পড়ছে না।
লিলিয়ান বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে বলল, উপরে চলে আস। দোতলাটা অসম্ভব সুন্দর। মার্বেল পাথরের মেঝে।
লিলিয়ানের খুব ভালো লাগছে। সে হারিকেন হাতে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি কিশোরীর মতো। যে ঘরে আজ রাতে তারা থাকবে সেই ঘর দেখে সে মুগ্ধ। বিশাল দুটা জানালা। জানালার পাশে দাঁড়ালেই দূরের ব্ৰহ্মপুত্র দেখা যায়। নদীতে চর পড়েছে। চারের ধবধবে সাদা বালি চাদের আলোয় চিকচিক করছে। কী হাওয়া! উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। শোবার ঘরটা কী প্ৰকাণ্ড! যেন ফুটবল খেলাব মাঠ। মাঠেব মাঝখানে খাট পাতা হয়েছে। কালো রঙের একটা খাট, যার চারদিকে রেলিং দেয়া। খাটে সরাসরি উঠার উপায় নেই, এত উঁচু। টুলে পা দিয়ে উঠতে হয়। ঘর ভর্তি ভারী ভারী আলমিরা। লিলিয়ান প্রতিটি আলমিরা খুলে দেখল। সব শূন্য। খাটের মাথার কাছে গোল শ্বেত-পাথরের টেবিল। এ বাড়ির অনেক দরজা-জানালা লোকজন খুলে নিয়ে গেছে। এগুলি নেয় নি কেন?
লিলিয়ান বলল, এই টেবিল, এই খাট যে-কোনো মিউজিয়াম লুফে নেবে। মনে হচ্ছে হাজার বছরের পুরনো।
লিলিয়ানের মুগ্ধতা তাহেরকে স্পর্শ করছে না। সে বেশ ক্লাস্ত। বারান্দায় রাখা বালতির পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে সে বিছানায় বিরসমুখে বসে আছে। এ বাড়িতে রাত্রিযাপন ঠিক হবে কি-না তা বুঝতে পারছে না। সাপের ব্যাপারটা তাকে চিন্তিত করছে।
লিলিয়ান বলল, কথা বলছি না কেন?
কী বলব?
তোমাদের এইসব ফার্নিচারের বয়স কত?
তাহের হাই তুলতে তুলতে বলল, এদের বয়স দুশ বছরের মতো। সবই আমার দাদার বাবা বানিয়েছিলেন। খাটটা বাৰ্মা থেকে কেনা। এই যে বাড়ি দেখছ, এই বাড়িও উনার করা।
খুব ধনী মানুষ ছিলেন?
হতদরিদ্র ছিলেন। পরের বাড়িতে কামলা খাটতেন। সুপারির ব্যবসা করে ধনী হন। মাত্ৰ চল্লিশ বছর বয়সে তিনি লাখের বাতি জ্বলিয়েছিলেন।