স্যার, আপনের পরিবার বাংলা কথা কয়?
হুঁ।
ঐ মটর সাইকেলের মেমসোবও বাংলায় কথা কয়। কুমড়া কিনতে গিয়া পরিষ্কার বলছে–কুমড়ার কত দাম?
ঠিক মতো নৌকা চালান নূর মিয়া। বেশি কথা বলার দরকার নেই।
এইটা স্যার আপনার বলা লাগিব না। বেশি কথার মইদ্যে নূর মিয়া নাই। দেশটা নষ্ট হইতাছে অধিক কথার কারণে।
লিলিয়ান ইংরজিতে বলল, আহা বেচারা কথা বলতে এত পছন্দ করে আর তুমি তাকে কথা বলতেই দিচ্ছ না। বলুক না কথা। কী ক্ষতি তাতে? আমার তো ওর কথা শুনতে ভালো লাগছে।
বুঝতে পারছ?
কিছু কিছু পারছি। যতই কথা শুনব ততই আরো বেশি বুঝব।
তুমি এক কাজ কর–নূর মিয়ার সঙ্গে বসে বসে গল্প কর। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
চারদিকে অসহ্য সুন্দর, এর মাঝখানে তুমি ঘুমিয়ে পড়বে?
কাব্যভাব আমার একেবারেই নেই লিলি। আমি মানুষটা পাথর টাইপ। অনুভূতিশূন্য।
আমি কি এই অনুভূতিশূন্য মানুষটির কাছে একটি আবেদন রাখতে পারি?
হ্যাঁ পার।
আমেরিকায় ফিরে গিয়ে কী হবে? চল, আমরা এখানেই থেকে যাই।
তাহের সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, এই জঙ্গলে থেকে যেতে চাও?
হ্যাঁ চাই।
তোমার মাথা থেকে পোকাগুলি দূর কর লিলিয়ান। তুমি আমার গ্রামের বাড়ি দেখতে চেয়েছিলে বলে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে আমি থাকব খুব বেশি হলে তিন দিন। তারপর বাংলাদেশের সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলি ঘুরে ঘুরে দেখব–কক্সবাজার, মুরুসিলেট। তারপর যাব নেপাল। হিমালয়-কন্যা নেপাল দেখার পর আমেরিকা ফিরে যাব।
লিলিয়ান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে শান্তগলায় প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমার একটা অদ্ভুত কথা মনে হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমাদের দুজনের কেউই এই জায়গা ছেড়ে কোনোদিন অন্য কোথাও যেতে পারব না। বাকি জীবনটা আমাদের থেকে যেতে হবে এইখানে।
তারা ইন্দরঘাটে পৌঁছল সন্ধ্যার পর। কাকতালীয়ভাবেই পূর্ণিমা পড়ে গেছে। চাঁদ উঠেছে, তবে চাঁদের আলো এখনো জোরালো হয় নি। গাছপালায় সব কেমন ভুতুড়ে অন্ধকার। তাহের বলল, হাত ধর লিলিয়ান, বনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। এক সময় এটা ছিল সুন্দর বাগান। এখন পুরোপুরি ফরেস্ট। হালুম শব্দ করে বাঘ বের হয়ে এলেও অবাক হবো না। এখনো বের হচ্ছে না কেন সেও এক রহস্য।
বাড়ি দেখে লিলিয়ান একই সঙ্গে মুগ্ধ ও দুঃখিত হলো। বিশাল অট্টালিকা, কিন্তু অন্তিম দশা। বাড়ির পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। দক্ষিণ দিকের দেয়াল ধসে পড়েছে। পুরো বাড়ি ঘন শ্যাওলায় ঢাকা। দোতলায় উঠার সিঁড়ি ভাঙা, বেলিং ধসে গেছে। একতলার বারান্দায় গোবরের স্তুপ দেখে মনে হয় বৃষ্টির সময় এই জায়গা গরু-ছাগলের আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তাহের বিরস গলায় বলল, বাড়ি দেখলে লিলিয়ান?
হ্যাঁ দেখলাম।
কোনো কমেন্ট করতে চাও?
চাই।
কবে ফেল।
এই বাড়ি আমার চেনা। আমি এই বাড়ি আগে দেখেছি। তোমাকে আমি লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ির কথা বলেছিলাম। তুমি বলেছিলে–এরকম সিঁড়ি নেই। সেই সিঁড়ি কি এখন দেখতে পাচ্ছ? স্বপ্নে আমি অবিকল এই সিঁড়ি, এই বাড়ি দেখেছি।
লোহার সিঁড়ি তাহেরের চোখে পড়ল। বাড়ির যে অংশ ধ্বসে পড়েছে সিঁড়ি সেই দিকে। সিঁড়ির গা ঘেঁসে তেঁতুল পাতার মতো চিকন পাতার একটা গাছ। তাহের বলল, আমি এ বাড়িতে খুব ছোটবেলায় থেকেছি। এই কারণেই সিঁড়ি চোখে পড়ে নি। যাই হোক, তুমি দাবি করছি এই বাড়িই তুমি স্বপ্নে দেখেছ?
হুঁ।
স্বপ্নের সব ভাঙা বাড়ি এক রকম হয়।
লিলিয়ান ক্লান্ত গলায় বলল, হয়তো হয়।
তাহেরের দূর-সম্পর্কের চাচা ইস্কান্দর আলী, তার দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। হাতে হারিকেন। এই গরমেও ইস্কান্দর আলীর গায়ে চান্দর। পরনের লুঙ্গিটা সিস্কের, চিকচিক করছে। সঙ্গের ছেলে দুটিব গায়ে গেঞ্জি। দুজনেরই শক্ত-সমর্থ চেহারা। এরা কোনো কথা বলছে না, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লিলিয়নের দিকে। তাকানোর ভঙ্গি শালীন নয়। তাহের একবার ভাবল ধমক দিয়ে বলে, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? বলল না। নিজেকে সামলে নিল। চাচার দিকে তাকিয়ে বলল, বাড়ির অবস্থা তো শোচনীয়।
ইস্কান্দর আলী কাশতে কাশতে বললেন, পুরানা বাড়ি, এর চেয়ে ভালো আর কী হইব? ভাইঙ্গা যে পড়ে নাই এইটাই আল্লাহর রহমত।
ঠিকঠাক করার জন্যে প্রতি মাসে টাকা পাঠাই।
প্রতিমাসে পাঠাও না। মাঝে-মইদ্যে পাঠাও।
অবস্থা যা তাতে মনে হয় না। এ বাড়িতে থাকা যাবে।
থাকতে পারবা। দুইতলার কয়েকটা ঘর পরিষ্কার করাইয়া থুইছি।
থাকা যাবে?
হ, যাবে। সাথের এই মাইয়া কি তোমার ইসাতিরি?
হ্যাঁ।
খিরিস্তান বিবাহ করছ?
হ্যাঁ।
মেয়ে দেখতে সুন্দর আছে। বিবাহ করছ ভালো করছি। খিরিস্তান বিবাহ করা জায়েজ আছে। নবী করিম নিজেও একটা খিরিস্তান মেয়ে বিবাহ করেছিলেন।
বাবুর্চির ব্যবস্থা করতে লিখেছিলাম। ব্যবস্থা করেছেন?
গোরাম দেশে বাবুর্চি কই পামু? আমার ঘরে রান্ধা হইব। টিফিন বাক্সে কইবা তোমরারে খানা দিয়া যাব। তোমরা থাকবা কয় দিন?
এখনো বলতে পারছি না।
ডাকাইতের খুব উপদ্রব। বেশি দিন না থাকনই ভালো।
আমার সঙ্গে আছে কী যে ডাকাত নেবে?
তোমার ইসাতিরিরে নিয়া যাবে। সুন্দর মেয়েছেলে–হইলদা চামড়া, বিলাতি। ডাকাইতরা খুশি হইয়া তোমার ইসাতিরিরে নিয়া যাবে।
আপনি কি আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছেন?
তোমারে ভয় দেখাইয়া আমার ফয়দা কী? তোমার স্ত্রী মাছ-ভাত খায়, না পাউরুটি খায়?
মাছ-ভাত খায়।