অ্যাডভেঞ্চার চাও, না smooth প্ল্যান চাও?
দুই-ই চাই।
ট্যুর প্ল্যানে হোটেলের ব্যবস্থাও থাকবে?
হ্যাঁ থাকবে।
ইকনমি হোটেল, না এক্সপেনসিভ হোটেল?
এক্সপেনসিভ হোটেল। ইকনমি হোটেলে আমি থাকতে পারি না–দম বন্ধ হয়ে আসে।
কোন মহাদেশ ঘুরতে চাও? ইউরোপ, এশিয়া? ইন্ডিয়া দেখে আস। ইন্ডিয়া এবং নেপাল। পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্য–সবই পাবে। তাজমহল আছে–সপ্তম আশ্চর্য…
তাহের হঠাৎ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি বরং আমাদের দুজনের জন্যে বাংলাদেশে একটা টুরের ব্যবস্থা কর।
বাংলাদেশ খুব ইন্টারেস্টিং হবে বলে আমার মনে হয় না।
আমার নিজেরও মনে হয় না। তবু কর।।
পুরো ট্যুরটাই হবে বাংলাদেশে?
হ্যাঁ।
কিছু মনে করবে না–বাংলাদেশে হানিমুন টুরে যেতে চাওয়ার কারণ কী জানতে পারি?
হ্যাঁ পার। এটা আমার নিজের দেশ। হো হো হো। হা হা হা।
অনেক দিন পর তাহের প্রাণখুলে হাসল। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, হ্যালো মিস, আমাকে মন্টানা যাবার একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দাও। এমনভাবে করবে যেন আমি রাতদুপুরে উপস্থিত হতে পারি। আমি আমার স্ত্রীকে চমকে দিতে চাই। হা হা হা।
রাত তিনটায় লিলিয়ান দরজা খুলল।
তাহের দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাদের খেলনার দোকান থেকে অদ্ভুত একটা মুখোশ কিনে মুখে পরেছে। মুখোশে তাকে ভয়ঙ্কর দেখানোর কথা। কেন জানি তা দেখাচ্ছে না। বরং হাস্যকর লাগছে। লিলিয়ান শিশুদের মতো চেঁচিয়ে উঠে বলল–এ কী। তুমি?
তাহের মুখোশের আড়াল থেকে হাসতে হাসতে বলল, ইয়েস বিদেশিনী, আমি।
চলে এলে যে?
তোমাকে দেখতে এলাম, তুমি কেমন আছ?
লিলিয়ান ঝলমলে গলায় বলল, খুব খারাপ ছিলাম। এখন আর খারাপ নেই। আমি এখন ভালো আছি। খুব ভালো আছি।
ভালো থাকলে চমৎকার করে কাঁপাচিনো কফি বানাও। প্রচুর ফেনা যেন হয়, এবং জিনিসপত্র গোছগাছ করা শুরু কর।
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আমরা যাচ্ছি। বাংলাদেশের একটি জেলা নেত্রকোনায়। নেত্রকোনা থেকে নান্দাইল রোড স্টেশন বলে অখ্যাত একটা রেলস্টেশনে। সেখান থেকেও কুড়ি মাইল দূরের অতি দুৰ্গম এক স্থানে। যেখানে আমার পূর্বপুরুষরা বোকার মতো এক বিশাল অট্টালিকা বানিয়েছিলেন। সেই অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে আসব। ঐ অঞ্চলে পৌঁছতে যেসব যানবাহনে আমরা চড়ব সেসব হচ্ছে–প্লেন, রেল, নৌকা, মহিষের গাড়ি, সবশেষে হন্টন।
হান্টন মানে কী?
হন্টন মানে আমি বলব না। বাংলাদেশে যাচ্ছ, কাজেই এখন থেকে কথাবার্তা হবে বাংলায়। তুমি বুঝতে পারলে ভালো কথা, বুঝতে না পারলে নেই।
এত দ্রুত কথা বললে বুঝব কী করে? স্নোলি বলো, আমি সবই বুঝব।
বাংলা এমনই ভাষা যা স্নো বলা যায় না। অতি দ্রুত বলতে হয়। দ্রুত কথা বলা শিখে নাও। আমাদের দেশের লোকজন কাজকর্ম করে টিমাতালে কিন্তু কথা বলে দ্রুত। হা হা হা।
রেল, নৌকা, মহিষের গাড়ি
রেল, নৌকা, মহিষের গাড়ি এবং হন্টনের কথা বলা হলেও ট্রেন থেকে নেমে সরাসরি নৌকা নিয়ে বাড়ির ঘাটে যাওয়া যায়। ঘাটের নাম ইন্দারঘাট, গ্রাম তিলাতলা। তাহের নৌকা নিয়েছে, ঠাকরাকোনা থেকে ইন্দরঘাট যাবে। দুই মাঝির নৌকা। দুই মাঝির একজনের বয়স দশ-এগার। সে আবার দার্শনিক প্রকৃতির। বেশির ভাগ সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রশ্ন করলে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। তার নীরবতা অন্যজন পুষিয়ে দেয়। একটা কথা জিজ্ঞেস করলে দশটা কথা বলে।
তাহের বলল, কতক্ষণ লাগবে? বালক মাঝি উত্তর দিল না, মুখ ঘুরিয়ে নিল। বালক মাঝির বাবা হাসিমুখে বলল, একটানে লইয়া যামু। একটানের মামলা।
টান দিতে পারবেন তো? আপনার নিজের অবস্থা দেখছি কাহিল–ছেলেটাও নিতান্তই শিশু।
বিছনা কইরা দিতাছি। শুইয়। ঘুমান। ইন্দরঘাটে ঘুম থাইক্যা ডাইক্যা তুলব। সাথের মেমসোব আফনের কী লাগে?
আমার স্ত্রী।
গত বছর একজন মেমসাব দেখছিলাম। হাফপেন্ট পরা। নবীনগর হাটবারে মোটর সাইকেল নিয়া আসছে। একটা কুমড়া কিনছে। কুমড়া এরা খুব ভালো পায়। শখ কইরা খায়।
আপনি নৌকা ছাড়ার ব্যবস্থা করুন তো দেখি।
সব ব্যবস্থা হইতেছে। নূর মিয়ার নৌকায় উঠছেন। আর চিন্তার কিছু নাই।
নৌকা ছাড়ার পর মনে হলো চিন্তার অনেক কিছুই আছে। নূর মিয়া নিজে পিচা করছে না, হাল ধবে বসে আছে। বাচ্চা ছেলে একা দাঁড় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দর্শ পথ যেতে দীর্ঘ সময় লাগবে। দিনে দিনে পৌঁছানোর আশা মনে হচ্ছে ছেড়ে
লিলিয়ান খুব আগ্রহ নিয়ে নদী দেখছে। তার কেমন লাগছে বোঝা যাচ্ছে না। কালো চশমায় তার চোখ ঢাকা। তাহের বলল, কেমন লাগছে লিলিয়ান?
খুব ভালো লাগছে–অদ্ভুত লাগছে। আশা করি খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই জার্নি শেষ হবে না।
না, এই জানি বলতে গেলে অনন্তকাল ধরে চলবে। তুমি ইচ্ছা করলে ঘুমিয়ে পড়তে পার।
আমি ঘুমুব না।
খিদে পেয়েছে?
না।
স্টেশনে কিছু খেয়ে নেয়া দরকার ছিল। অল্পক্ষণের ভেতর খিদে পাবে। তখন নদীর পানি ছাড়া কিছুই খেতে পারবে না।
নূর মিয়া তাদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, খাওয়া-দাওয়া নিয়া কোনো চিন্তা কইরেন না। বসিরহাট বাজারে নৌকা ভিরামু। বাজার সদাই কইরা রান্ধা চাপামু, খাওয়া-দাওয়া শেষ কইরা বেলাবেলি চইল্যা যামু ইন্দারঘাট। একটানের মামলা।
তাহের দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তার কাছে মনে হচ্ছে নূর মিয়া খুব যন্ত্রণা করবে। তাদের প্রতিটি কথায় অংশগ্রহণ করবে। নিজস্ব মতামত দেবে। রান্নাবান্নায় অনেক সময় নষ্ট করার গরিকল্পনাও নূর মিয়ার আছে বলে মনে হচ্ছে।