ভালো।
গলা শুনে তো ভালো মনে হচ্ছে না। অসুখ-বিসুখ করেছে না-কি?
না, ঘুম পাচ্ছে।
এখনই ঘুম পাচ্ছে কেন? রাত তো বেশি হয় নি। কটা বাজে তোমাদের ওখানে?
দশটা।
দশটা তো তেমন বাত না। তুমি ঘুমে কথা বলতে পারছি না। ব্যাপার কী?
আমি ঘুমের ওষুধ খেয়েছি।
কেন?
কয়েক রাত ধবে আমার ঘুম হচ্ছে না। আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি।
ও আচ্ছা।
লিলিয়ান জড়ানো স্বরে বলল, তোমাকে একটা জরুরি কথা জিজ্ঞেস করি। খুব জরুরি। আচ্ছা, তোমাদের গ্রামের বাড়িটা বিশাল না?
হ্যাঁ বিশাল। হঠাৎ এই প্রসঙ্গ কেন?
কারণ আছে। এখন বলে তোমাদের বাড়ির বাইরেব দিকে ছাদ পর্যন্ত লোহার প্যাচানো সিঁড়ি আছে না?
না নেই।
আগে এক সময় ছিল। এখন নেই।
কখনো ছিল না। কোনো কালেও ছিল না। সিড়ির কথা এলো কেন?
এখন কথা বলতে পাবিব না–খুব ঘুম পাচ্ছে।
হ্যালো লিলিয়ান–হ্যালো।
লিলিয়ান টেলিফোন নামিযে রেখে সোফাব ওপর ঘুমিয়ে পড়ল। আবার ঘুম ভাঙল টেলিফোনেব শব্দে। লিলিয়ান জড়ানো গলায় বলল, হ্যালো।
মিসেস লিলিয়ান।
ইয়েস।
ইউনাইটেড ট্রাভেল এজেন্সি থেকে বলছি–আপনি ভিয়েনার বুকিং চেয়েছিলেন। আগামীকাল বুকিং পাওয়া গেছে। লন্ডন ফ্রাংকফোর্ট হয়ে ভিয়েনা। লন্ডনে একরাত থাকতে হবে।
কোথায় থাকব?
এয়ারপোর্ট হোটেল। এয়ারপোর্টের কাছেই।
আচ্ছা, এই হোটেলে কি প্যাচানো লোহার সিঁড়ি আছে?
ম্যাডাম আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না। লিলিয়ান টেলিফোন রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে সেই প্যাচানো সিঁড়ি আবার দেখল। সে সিড়ি দিয়ে নামছে। অতি দ্রুত নামছে। সিঁড়ি কাঁপছে–মনে হচ্ছে পড়ে যাবে। লিলিয়ান ঘুমের মধ্যেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
তাহেরের নার্ভ শক্ত
তাহেরের নার্ভ শক্ত।
শুধু শক্ত না, বেশ শক্ত। চরম বিপদেও তার মাথা ঠাণ্ডা থাকে। ভিয়েনায় সে কোনো বিপদের মধ্যে নেই। সুখেই আছে বলা চলে। সেমিনার চলছে। পেপার পড়া হচ্ছে, তবে আড্ডা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। প্ৰতি সন্ধ্যায় ককটেল পার্টি। হৈচৈ, নাচানাচি। তাহের এই হৈচৈ-এ নিজেকে মেশাতে পারছে না। মনে হচ্ছে তার ইস্পাতের নার্ভে ও মরিচা ধরে গেছে। গত রাতে এক ফোঁটা ঘুম হয় নি। এরকম অদ্ভুত ঘটনা তাহেরের জীবনে খুব বেশি ঘটে নি। বিছানায় যাবার আগেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। তার অনিদ্রার কারণ লিলিয়ান। লিলিয়ানের সমস্যাটা সে ঠিক ধরতে পারছে না। টেলিফোনে প্যাচানো সিঁড়ির কথা কেন জিজ্ঞেস করল? তাহেরকে এত আগ্রহ করে সে কেনইবা বিয়ে করল? আমেরিকান মেয়েগুলির কাছে বিয়ে এবং ডিভোর্স দুই-ই ডালভাত। চব্বিশ ঘণ্টার পরিচয়ে তারা বিয়ে করে ফেলে, আবার এক সপ্তাহ পর ছাড়াছাড়ি। দুজন দুদিকে গিয়ে অন্য দুজনকে খুঁজে নেয়। কিন্তু লিলিয়ান এ রকম মেয়ে নয়। সে কেন তাহেরের মতো আধা-বাউণ্ডেল একজনের জন্যে এতটা ভালোবাসা জমিয়ে রাখবো?
লিলিয়ান কোনো একটি ব্যাপারে কষ্ট পাচ্ছে। সেই কষ্টের প্রকৃতি তাহের জানে না। জানার চেষ্টা করা কি উচিত? স্বামী-স্ত্রীর ভেতরও কিছু গোপন ব্যাপার থাকা প্রয়োজন বলে তাহের মনে করে। অবশ্যি ভিয়েনায় পা দেয়ার পর থেকে তাহেরের মনে হচ্ছে, সে ভুল করছে। তার উচিত ছিল লিলিয়ানের গোপন কষ্টের ব্যাপারগুলি জানা।
লিলিয়ানকে টেলিফোনে ধরার সব চেষ্টা বিফল হলো। সারা দিনে তাহের ছবার চেষ্টা করল। রিং হয়, কেউ টেলিফোন ধরে না। লিলিয়ান কি ঘর তালাবন্ধ করে কোথাও গেছে? না-কি ষ্ট্রোক হয়ে ঘরে মারে পড়ে আছে? তাহের খুব অস্থির বোধ করতে লাগল। সেমিনারে একেবারেই মন বসছে না। ইচ্ছা করছে ব্যাগ গুছিয়ে প্লেনে উঠে বসতে। রাতদুপুরে বাড়িতে পৌঁছে আমেরিকানদের মতো চেঁচিয়ে বলতে—Honey I am home.
সেমিনারে Cataract solvent-এর উপর বিরক্তিকর এক বক্তৃতা হচ্ছে। বক্তা মাঝে মাঝে হাসাবার চেষ্টা করছেন, পারছেন না।
বক্তৃতার মাঝখানে তাহেরের কাছে স্নিপ এলো, আমেরিকা থেকে জরুরি কল। তাহের টেলিফোন ধরবার জন্যে প্রায় ছুটে গেল। যিনি পেপার পড়ছিলেন তিনি পড়া বন্ধ করে কড়া চোখে তাকিয়ে রইলেন।
টেলিফোন করেছে লিলিয়ান। তাহের বলল, কেমন আছ লিলিয়ান?
ভালো আছি।
কোনো বিশেষ কারণে টেলিফোন করেছ, না এমনি?
এমনি করেছি। আমি কি তোমাকে বিরক্ত করলাম?
মোটেও বিরক্ত কর নি, বরং খুব আনন্দিত করেছ। আমি তোমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছিলাম। ঐদিন হঠাৎ টেলিফোন রেখে দিলে…
খুব ঘুম পাচ্ছিল, শরীর ভালো লাগছিল না।
প্যাচানো সিড়ির কথা জিজ্ঞেস করছিলে কেন?
ও কিছু না। বাদ দাও।
লিলিয়ান, এখন তোমার শরীর কেমন?
শরীর ভালো। তুমি আমাকে নিয়ে মোটেও চিন্তা করবে না। তুমি ঠিকমতো তোমার সেমিনার কর। কোর্স ওয়ার্ক কবে থেকে শুরু হচ্ছে?
তাহের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে খুব নরম গলায় বলল, লিলিয়ান, তুমি কি আমার একটা প্রশ্লেব জবাব দেবে?
অবশ্যই দেব?
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তুমি এক ধরনেব ক্রাইসিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ক্রাইসিসের কারণটা কি আমি জানতে পারি?
না।
বেশ, জানাতে না চাইলে জানাতে হবে না। এমন কিছু কি আছে যা তুমি আমাকে বলতে চাও?
হ্যাঁ।
তাহলে বলো।
I love you.
অন্য সময় হলে তাহের হো-হো করে হেসে ফেলত। আজ পারল না। তার অসম্ভব মন খারাপ হয়ে গেল। টেলিফোন নামিয়ে রেখে সে দুটা কাজ করল। প্রথম কাজ, কোর্স কো-অর্ডিনেটরকে বলল, আমার একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমি আমেরিকা ফিরে যাচ্ছি। দ্বিতীয় কাজ, ট্র্যাভেল এজেন্সিতে টেলিফোন করে বলল, আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে দুমাস ঘুরে বেড়াব। খুব ইন্টারেস্টিং একটা ট্যুর প্ল্যান তুমি তৈরি করে দাও। ট্যুর প্ল্যানে সমুদ্র, পাহাড়, অরণ্য–এই তিনটি জিনিসই থাকতে হবে। আমরা বিয়ের পর একসঙ্গে বাইরে কোথাও যাই নি। এটা হবে আমাদের হানিমুন ট্যুর।