কোনোক্রমেই কি যাওয়া সম্ভব না?
না। তাছাড়া লিলিয়ান সামারে বাংলাদেশ তোমার ভালোও লাগবে না। ট্রপিক্যাল কান্ট্রি। প্ৰচণ্ড গরম। টেম্পারেচার চৌত্ৰিশ ডিগ্রি পয়ত্ৰিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে। হাই হিউমিডিটি। গা থেকে আলকাতরার মতো ঘাম বের হয়।
আমার কোনোই অসুবিধা হবে না।
হবে। আমার পৈতৃক বাড়িতে ইলেকট্রসিটি নেই। হাতপাখা হচ্ছে একমাত্র পাখা। প্রচণ্ড মশা। বাড়ির চারদিকে বাগানটা সুন্দর, কিন্তু সুন্দর হলেও বাগানে হাঁটতে পারবে না। বর্ষায় প্যাচপ্যাঁচে কাদা হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে আছে সাপের উপদ্ৰব।
তুমি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি।
ভয় দেখানোব চেষ্টা করছি না। সত্যি কথা বলছি। ভয় দেখাতে চাইলে বলতাম, আমাদের বাড়ির চারপাশে ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, এবং ফুলহাতি ঘুরে বেড়ায়। আমি মশার কথা বলেছি, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথা বলি লিলিয়ান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার খুব আশা ছিল আমি এই সামারেই তোমার পৈতৃক বাড়ি দেখতে যাব।
তোমার আশা আপাতত পূর্ণ হচ্ছে না। কোনো একদিন নিশ্চয়ই হবে। বাংলাদেশের মশা তোমাকে দেখিয়ে আনব। সব মশা এক্সপোর্ট কোয়ালিটির ইয়া সাইজ। একেক জন এক ছটাক দেড় ছটাক করে রক্ত খায়। রক্ত খেয়ে বমি করে ফেলে দেয়, আবার খায়। হা হা হা।
তাহেরের ভিয়েনায় এক মাসের জন্য যাবার কথা ছিল। সেটা বেড়ে হয়েছে দুমাস। সেমিনারের শেষে একটা শর্টকোর্স শেষ করে সে ফিরবে। তাহের খুব খুশি। লিলিয়ানের খারাপ লাগছে। বেশ খারাপ লাগছে। খারাপ লাগছে। এই ভেবে যে তাহের বুঝতে পারছে না তাহেরকে ছেড়ে একা একা বাস করা তার জন্য কত কষ্টের। সে তো অনায়াসে বলতে পারত-লিলি, তুমিও আমার সঙ্গে চল। ঘরদুয়াব তালাবন্ধ থাকুক। এই কথা একবারও বলছে না।
তাহেরের ফ্লাইট বুধবারে। সে মঙ্গলবার নাশতার টেবিলে কফি খেতে খেতে বলল, লিলি তুমিও চল। আমি সেমিনার করব, কোর্স করব–তুমি শহরে শহরে ঘুরবে। শুধু রাতে আমরা এক সঙ্গে ঘুমুব। এখানে একা একা এত বড় বাড়িতে থাকার তোমার দরকার কী? শেষে ভয়টয় পাবে।
না। আমি ভয় পাব না।
ভয় না পেলে থাক। বাড়ি খালি রেখে যাওয়া ঠিক না।
লিলিয়ানের কান্না পাচ্ছে–কেন সে বলতে গেল না। আমি ভয় পাব না। তাহের বলমাত্র সে বাজি হলো না কেন? এখন কি সে বলবে–আমি একা একা এখানে থাকতে চাচ্ছি না। আমি তোমার সঙ্গে যাব। তুমি আমার জন্যও একটা টিকিট করা। না, তা বলা সম্ভব না। এমন ছেলেমানুষি কিছু সে করতে পারবে না।
লিলিয়ান।
হুঁ।
তুমি স্বীকার না করলেও আমি বুঝতে পারছি দুমাস একা একা থাকা তোমার জন্য কষ্টকর হবে। তোমাকে আমি একটা সাজেশান দেই। তুমি তোমার বাবা-মার কাছ থেকে ঘুরে আস। ওদের রাগ ভাঙিয়ে আস।
ওদের রাগ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই বলেই তুমি এমন কথা বললে। এই রাগ ভাঙবার নয়।
আমার ধারণা তাদের সামনে গিয়ে তুমি কান্নাকাটি শুরু করলেই–রাগ গলে জল হয়ে যাবে। চেষ্টা করে দেখ।
চেষ্টা করে লাভ হবে না। আমার পজার চাচা মারা গেছেন, কেউ আমাকে এই খবরটাও দেয় নি। আমি জেনেছি। অন্য একজনের কাছে।
এরা কোনোদিনই তোমাকে গ্ৰহণ করবে না?
তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, কিংবা মারা গেলে হয়তো বা করবে।
তোমাকে ছেড়ে যাবার প্রশ্ন উঠে না। মৃত্যু বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। যে প্লেনে উঠছি সেই প্লেনটাই ক্র্যাশ করতে পারে। তবে তোমাকে পৈতৃক বাড়ি না দেখিয়ে আমি মরব না। এ বিষয়ে নিশ্চিত থাক।
লিলিয়ানের খুব খারাপ লাগছে। হঠাৎ মৃত্যু প্রসঙ্গ চলে এলো কেন? এই প্রসঙ্গ তো আসার কথা ছিল না।
লিলিয়ান।
হুঁ।
আমি প্রতিদিন একবার টেলিফোন করব।
আচ্ছা।
তোমার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে একটা খাম রেখে যাচ্ছি। আমি বাসা থেকে বেরুবার পর খাম খুলবে। তার আগে নয়।
কী আছে খামে?
কিছু না। আরেকটা কথা, তুমি যদি একা থাকতে ভয় পাও তাহলে ঘরে তালা দিয়ে পরিচিত কারোর বাড়িতে উঠে পড়বে। কিংবা কোনো হোটেলে।
আমি ভয় পাব না।
তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে এখনি ভয় পাচ্ছ। আমি চোখের ডাক্তার। চোখ বিশেষজ্ঞ। চোখ দেখে অনেক কিছু বলে দিতে পারি। হা হা হা।
লিলিয়ান তাহেরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, I love you.
লিলি!
হুঁ।
এই দুমাসে তুমি কি দয়া কবে একটা কাজ করবে, গাড়ি চালানোটা শিখে নেবে? এটা কোনো কঠিন ব্যাপার না। ড্রাইভিং-এর যে-কোনো স্কুলে ভর্তি হলেই হবে। গাড়ি চালানো জানলে তুমি আমাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে আসতে পারতে। দুজন গল্প করতে করতে যেতাম। এখন যাব। ক্যাবে করে। বিশ্ৰী ব্যাপার।
তাহের ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র লিলিয়ান ড্রয়ার খুলল। সেখানে একটা চিঠি। চিঠিতে লেখা–প্ৰিয় লিলি, খামের ভেতর একটা ভিয়েনা যাবার ওপেন টিকিট আছে। টিকিটাটা তোমার জন্য। যখন ইচ্ছে করবে তুমি চলে আসবে। আমি জোর করেই তোমাকে নিয়ে যেতাম। যাই নি। কারণ আমি সারাদিন থাকব ব্যস্ত, তুমি একা একা হোটেলে বসে থাকবে। নিজের স্বার্থে তোমাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করল না। এরচে ওপেন টিকিট ভালো। এখানে একা একা থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়লে চলে আসবে। তখন ভিয়েনার হোটেলে বসে বিরক্ত হলেও আমাকে দোষ দিতে পারবে না। কারণ তুমি এসেছ নিজের আগ্রহে। হা হা হা।
লিলিয়ান সঙ্গে সঙ্গেই ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করল। যদি বুকিং পাওয়া যায়। সম্ভব হলে আজ।