যে লোক এমন কঠিন প্রতিজ্ঞা করতে পারে তার উপর ভরসা করা যায়। জমির আলী ভরসা করে আছে এবং মোটামুটি নিশ্চিন্ত আছে। তার তিনকন্যাকে নিয়ে যে দুঃশ্চিন্তা তাও বলরাম বহুলাংশে দূর করেছে। বলরামের বিশেষ ক্ষমতা আছে তার নাম নখ-দর্পণ। বুড়ো আঙুলের নখে তিমির তেল মাখিয়ে সে যদি এক ধ্যানে সে-দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে নখ আয়নার মতো হয়ে যায়। যাকে দেখতে ইচ্ছা করে তাকেই আয়নায় দেখা যায়। জেলের সবাই যদিও বলে এটা বলরামের ভাওতাবাজি। টাকা কামাবার ফন্দি। (এক একবার নখদর্পণে বলরামকে এক প্যাকেট সিগারেট কিংবা দুই পুরিয়া গাজা দিতে হয়। তারপরেও প্রায়ই কয়েদিরা তার কাছে আসে নখদর্পণে তাদের পরিবার পরিজনদের খবর নেয়। জমির আলীর কাছ থেকে বলরাম কিছুই নেয় না। জমির আলী অন্যদের মতো বলরামকে অবিশ্বাসও করে না। বানিয়ে বানিয়ে একটা লোক তার কাছে শুধু শুধু মিথ্যা বলবে কেন?
জমির আলী যখনই তিন কন্যার বিষয়ে জানতে চায় তখনি বলরাম ধ্যানে বসে এবং অতি অল্পসময়ে ফল পাওয়া যায়।
দুইজনরে দেখতেছি। আরেকজন গেল কই?
দাদা, কোন দুইজন?
বড় দুইজন।
বুঝেছি আসমানী আর জামদানী। সর্বনাশ হয়েছে, ছোটটাকে কই রেখেছে? বড় দুই বোন করতেছে কী?
বুঝতেছি না–ছবি স্পষ্ট না।
দাদা, আরেকটু নজর করে দেখেন।
এখন দেখা যাইতেছে।
পরিষ্কার?
আয়নার মতো পরিষ্কার।
দুই বোন করতেছে কী?
একজনের হাতে একটা নারিকেল।
বুঝেছি–সরকারবাড়ির ছেলের বউ দিয়েছে। অতি ভালো মহিলা। প্রায়ই। এটা সেটা দেয়। আল্লাহ এই মহিলাকে বেহেশত নসিব করুক। দাদা, ছোটটারে দেখতেছেন?
না।
ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম। পয়সারে তারা কার কাছে দিল?
পেয়েছি। ছোটটাকে পেয়েছি।
কোথায় আছে?
শুয়ে আছে। হাত-পা নাড়তেছে।
দুইবোন কি আশেপাশে নাই?
থাকলেও ধরা পড়তেছে না।
ছোটজন কোথায় শুয়ে আছে? খাটে না উঠানে?
ধরতে পারতেছি না।
শরীর স্বাস্থ্য কি ঠিক আছে?
ঠিক আছে। হাসিখুশি। হাত-পা নাড়তেছে। অতিরিক্ত নাড়তেছে।
কারেক্ট ধরেছেন দাদা। জন্মের পর থেকে ছোটটার হাত-পা নাড়ার অভ্যাস। অতিরিক্ত চঞ্চল হয়েছে। দুঃশ্চিন্তা এই জন্যেই বেশি।
দেখা বন্ধ করে দেই, মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।
আচ্ছা বন্ধ করেন। আপনার অশেষ মেহেরবানী। বড় দুইজনের শরীর স্বাস্থ্য কেমন দেখেছেন?
ভালো। তবে একজনের মনটা মনে হলো সামান্য খারাপ।
বুঝেছি আর বলতে হবে না। মেজো জন। এ অল্পতেই মন খারাপ করে। সে আবার পোলাও খাওয়ার যম। দিন রাত পোলাও পোলাও করে। তিন মেয়ে আর তার মাকে নিয়ে আপনার বাড়ি থেকে বেড়ায়ে যাব ঠিক করেছি। বাকি আল্লাপাকের ইচ্ছা।
বলরাম যে শুধু নখদর্পণের মাধ্যমেই তাকে সাহায্য করছে তা-না। দেশে চিঠি পাঠাবার ব্যাপারেও সাহায্য করে। মাসে দুটা চিঠি জেল থেকে পাঠাবার নিয়ম আছে। চিঠি লিখে ঠিকানাসহ জেল অফিসে জমা দিতে হয়। জেলের রাইটার চিঠি পড়ে পাঠাবার যোগ্য বিবেচনা করলে চিঠি পাঠায়। সেইসব চিঠি–কি কখনো প্রাপকের কাছে পৌঁছে না। বলরামের ব্যবস্থা ভিন্ন, সে চিঠি পাচার করে দেয়। তার মাধ্যমে প্রতি মাসে দুটা করে চিঠি জমির আলী দেশে পাঠাচ্ছে। একটা চিঠি যাচ্ছে তিন মেয়ের কাছে। আরেকটা যাচ্ছে ইয়াকুব সাহেবের কাছে। ইয়াকুব সাহেবের কাছে সে খোলাখুলি সব বৃত্তান্ত লিখছে। উনি ভদ্রলোক এবং জ্ঞানী মানুষ। উনার কাছে কিছু লিখলে তিনি ঢোল পিটিয়ে প্রচার করবেন না। মেয়েদের কাছে মিথ্যা করে লিখতে হচ্ছে। বাবা জেলে আছে–এই ব্যাপারটা তারা নিতে পারবে না। ভাববে চুরি-ডাকাতি করে জেলে গেছে। তাদের কাছে মিথ্যা বলাই ভালো। নিজের মেয়েদের কাছে মিথ্যা বলার। কারণে বিরাট পাপ হচ্ছে। রোজহাশরে বিরাট বিপদে পড়বে। ভরসা একটাই নবিজিকে স্বপ্নে দেখেছে। নবিজি নিশ্চয়ই সাফায়াত করে কোনোরকমে তাকে পার করে নিয়ে যাবেন। প্রতি চিঠিতেই সে মেয়েদেরকে লিখছে—
ও আমার আদরের তিন মা ময়না সোনা, হলদী পক্ষী। পর সমাচার আমি ভালো আছি। তোমার মায়ের সন্ধান উড়া উড়া পাইয়াছি। নিশ্চিত পাই নাই। যেহেতু নবি করিমের নামে ওয়াদা করিয়াছি তোমার মাকে না নিয়া ফিরিব না সেহেতু কিঞ্চিত বিলম্ব হইতেছে। তবে দুঃশ্চিন্তা করিও না, অবশ্যই তোমার মাতাকে সঙ্গে নিয়া ফিরিব। তোমাদের কাছে এই আমার ওয়াদা। তোমাদের আল্লাহপাকের কাছে সোপর্দ করিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত আছি। অবশ্যই আল্লাহপাক তোমাদের দেখভালের ব্যবস্থা নিবেন। তিনি বড়ই দয়াময় বলিয়াই তাহার নাম রহমান রহিম। সর্বঅবস্থায় সর্ববিষয়ে আল্লাহপাকের উপর ভরসা রাখিবে। মাঝে মাঝে আমাকে পত্র দিবে। কীভাবে পত্র দিবে তাহা বলিয়া দিতেছি। এনজিও ইয়াকুব সাহেবকে গিয়া বলিবে–পিতার নিকট পত্র দিতে চাই। এই বার্তা বলিতে চাই। তখন তিনি বাকি ব্যবস্থা করিবেন। আমার ঠিকানা উনার নিকট আছে।
দোয়াগো
তোমাদের পিতা জমির আলী
ইয়াকুব সাহেবের কাছে সে বিস্তারিত লিখছে। কীভাবে জেলে ঢুকে গেল সেই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে। কোনো কিছুই বাদ দেয় নাই। সম্পূর্ণ বিনা কারণে তার যে দীর্ঘদিনের জেল হয়েছে এই নিয়ে সে কোনো দুঃখ বা ক্ষোভ প্রকাশ করে নাই। কারণ সে জানে সবই আল্লাহপাকের খেলা। তার হুকুম ছাড়া কিছুই হয় না। এর পেছনেও তাঁর হুকুম আছে। এবং সে নিশ্চিত যে জেলবাসের পিছনে কোনো মঙ্গলও আছে। আল্লাহপাকের প্রতিটি কাজের পিছনে মঙ্গল থাকে। বোকা মানুষ তা বুঝতে পারে না। জমির আলী মঙ্গলের ব্যাপারটা এখনই বুঝতে পারছে না, তবে কিছুদিনের মধ্যে সে অবশ্যই বুঝতে পারবে। সর্বশেষ চিঠিতে সে ইয়াকুব সাহেবকে লিখল—