স্বপ্নের এই পর্যায়ে জমির আলীর ঘুম ভেঙে যায়। তার মনটা হয় উদাস। স্বপ্নে আছিয়াকে খুবই সুন্দর লাগছিল। কানে ছিল স্বর্ণের দুল। এই দুল জোড়া আসমানীর অসুখের সময় বিক্রি করতে হয়েছে। দুল আর কিনে দেয়া হয় নি। বিবাহিত মেয়েদের গায়ে স্বর্ণের ছোঁয়া না থাকলে দোষ লাগে। এক আনা সোনা হলেও গায়ে রাখতে হয়। সেটা করা সম্ভব হয় নি বলেই আছিয়ার গায়ে দোষ লেগে গেছে। সে সংসার ছেড়ে চলে গেছে। মেয়েদের যেমন স্বর্ণ পুরুষদের তেমন আকিক পাথর। নবিজি নিজে আকিক পাথর পরতেন।
জমির আলী বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার মুখে মুখে। বাড়িতে পা দিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। সব ঠিক-ঠাক আছে। কলসি ভর্তি পানি আছে। উঠান পরিষ্কার। চুলার কাছে শুকনা খড়ি সাজানো। অজু করার জন্যে জলচৌকির কাছে বদনা ভর্তি পানি। উঠানের খুঁটির সঙ্গে সাদা রঙের একটা মুরগি বাঁধা।
জমির আলী বিস্মিত গলায় বলল, এই মুরগি কার?
আসমানী বলল, আমরার মুরগি। ছদগা পাইছি। বাপজান, তুমি আস্তে কথা বলো, পয়সা হবে ঘুমাইছে।
বাবার সাড়া পেয়ে জামদানী গামছা হাতে বের হয়ে এসেছে। সে বাবার হাতে গামছা দিতে দিতে লজ্জিত গলায় বলল, পোলাও দিয়া মুরগির সালুন। খাইতে মনে চায় বাপজান।
জমির আলী দরাজ গলায় বলল, মনে চাইলে খাবি। আইজ রাইতেই খাবি। এইটা কোনো বিষয় না।
সত্যই?
অবশ্যই সত্য। জমির আলী ফকির হইলেও তার কথার দাম রাজা-বাদশার কথার দামের সমান। পোলাও কোর্মা আইজ রাইতেই হবে।
পোলাও-এর চাউল, ঘি গরম মশল্লা কই পাইবা?
এইগুলা নিয়া তোর চিন্তা করনের প্রয়োজন নাই। এইগুলা আমার বিষয়। মেয়েছেলে করব সংসার, পুরুষ করব চিন্তা–এইটা জগতের নিয়ম। এখন কথা বাড়াইস না। মাগরেবের ওয়াক্ত চইল্যা যাইতেছে। মাগরেবের ওয়াক্ত অতি অল্প সময়ের জন্যে থাকে। যদি দেখস গায়ের পশম দেখা যাইতেছে না তাহলে বুঝবি ওয়াক্ত শেষ হয়েছে।
সত্যি সত্যি পোলাও-কোরমা রান্না হয়েছে। দুই বোন নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। জমির আলী পয়সাকে কোলে নিয়ে পাশেই বসে আছে। আনন্দিত চোখে মেয়ে দুটির খাওয়া দেখছে। সে নিজে খেতে বসে নি। পোলাও-এর পরিমাণ কম। তিনজন খেলে কম পড়বে। শুধু দুই বোন যদি খায় আরাম করে খেতে পারবে। আসমানী বলল, বাপজান, তুমি খাইবা না?
জমির আলী বলল, না। আমার শইল জুইত নাই। শইল ঠিক করনের জন্যে উপাস দিব। শইল ঠিক করনের জন্যে উপাসের উপরে কোনো ওষুধ নাই। পোলাও-কোরমা খাইতে কেমন হইছে?
আসমানী বলল, অইত্যাধিক ভালো হইছে।
কই আমার মা জামদানী তো কিছু বলে না। ও জামি, খাদ্য কেমন হইছে?
জামদানীর মুখ ভর্তি খাবার। তার কথা বলার উপায় নেই। মুখে খাবার না থাকলেও সে কথা বলতে পারত না। খুব আনন্দের সময় সে কথা বলতে পারে না, তার চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ে। জমির বলল, আরাম কইরা খাও গো কইন্যারা। খাওয়া একটা ইবাদত। যত আরাম কইরা খাইবা ইবাদত তত শক্ত হইব। আল্লাহ সোয়াব দিয়া ভাসাইয়া দিব।
আসমানী বলল, তুমি কিছু খাইবা না এইটা কেমন কথা? এক মুঠ হইলেও খাও। দেই মুখে তুইল্যা?
জমির আলী উদাস গলায় বলল, দে।
আসমানী বাবার মুখে এক মুঠ খাবার তুলে দিল।
কন্যাদের সঙ্গে নিয়ে এটাই ছিল জমির আলীর শেষ খাওয়া। পরদিনই সে স্ত্রীর সন্ধানে দুর্গাপুর চলে যায়। সেখানে খবর পায় আছিয়া, আরো দুটা মেয়ের সঙ্গে বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে। জমির আলীও রাতের অন্ধকারে বর্ডার পার হয়। সেও নিখোঁজ হয়ে যায়।
জমির আলীর চেহারায় সুফি সুফি ভাব
জমির আলীর চেহারায় সুফি সুফি ভাব চলে এসেছে। দাড়ি অনেক লম্বা হয়েছে। দাড়ির সঙ্গে চুলও লম্বা হয়েছে। মুখ ভর্তি দাড়ি, ঘাড় পর্যন্ত বাবরি চুল। দেখেই মনে হয় সাধক মানুষ। তাকে সবাই ডাকছে সাধুজী।
জমির আলী আছে জেলে। প্রথম ছিল বারাসতের জেলে, সেখান থেকে এসেছে আলীপুরে। তার দুই বছরের কয়েদ হয়েছে। জেলখানায় লম্বা চুল দাড়ি রাখা নিষেধ। সে বিশেষ বিবেচনায় মাফ পেয়েছে। সাধু সন্ত মানুষ হিসেবে সবাই তাকে বিশেষ খাতির করে। তার ডিউটি রসুই খানায়। প্রথম কিছুদিন সে হেড বাবুর্চির অ্যাসিসটেন্ট ছিল। এখন সে-ই মূল বাবুর্চি। তার কাজে সবাই সন্তুষ্ট। সন্ধ্যাবেলায় শেষ গুণতির পর কয়েদিদের ভেতর যে আসর বসে সেই আসরে তাকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। সে গাঁজা সিগারেট কিছুই খায় না। অতি উচ্চশ্রেণীর ভাবের কথা বলে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ভাবের কথা শুনতে অন্যদের ভালোই লাগে।
জেলখানায় জমির আলীর কয়েকজন অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুও তৈরি হয়েছে। এদের একজনের নাম বলরাম। খুনের মামলায় যাবজ্জীবন হয়েছে। তের বছর পার হয়েছে। আর মাত্র দুই আড়াই বছর কাটিয়ে দিতে পারলে জেলখাটা শেষ হবে। জেলের যাবজ্জীবন মানে আঠারো বছর। ভালো আচার-ব্যবহারের জন্যে কিছু মাফ পাওয়া যায়। বলরাম তাকে গোপনে বলেছে জেল থেকে বের হয়ে সে তার স্ত্রীকে খুন করবে। সব কাজই তিনবার করতে হয়। দানে দানে তিনদান। জগতের এই নিয়ম। আগে খুন করেছে দুটা। প্রথমটায় কেউ কিছু ধরতে পারে নি। সাজা হয়েছে দ্বিতীয়টার জন্যে। সে আশা করছে তৃতীয়টাও কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। তৃতীয় কর্মটি সমাধা করতে পারলে দানে দানে তিনদানের ঝামেলা মিটবে।
বলরাম জমির আলীর অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বলরাম বলেছে জমির আলীর স্ত্রীকে খুঁজে বের করা মাত্র দশ দিনের মামলা। কোনো একটা খারাপ পাড়ায় সে আছে। কোথায় আছে পাত্তা লাগানো কোনো ব্যাপারই না। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হচ্ছে দুজন এক সঙ্গেই ছাড়া পাবে। জেল থেকে বের হয়েই বলরামের প্রথম কাজ হবে বন্ধু পত্নীকে খুঁজে বের করা। দ্বিতীয় কাজ নিজের স্ত্রীকে খুন করা। বলরাম এই বিষয়ে ওয়াদাবদ্ধ। সে পরিষ্কার বলেছে, সাধুজী এটা তুমি আমার উপরে ছেড়ে দাও। দশ দিনে যদি পাত্তা বের করতে না পারি বাটখারা দিয়ে মেপে আড়াইশ গ্রাম কাচা গু খাব।