শুধু যে কুলির কাজের জন্যে জমির আলী স্টেশনে যায় তাও না। তার মনে। আশা কোনো একদিন সে দেখবে আসমানীর মা ট্রেন থেকে নামছে। তখন জমির আলী কাছে এগিয়ে যাবে, কিছুই হয় নি এমন ভাব ধরে বলবে–কেমন আছ বউ? এদিকে খবর সবই মঙ্গল। কোনো চিন্তা করবা না। বউকে নিয়ে বাড়িতে রওনা হবার আগে আগে রেলস্টেশনের টি-স্টলে টোস্ট বিস্কিট দিয়ে এক কাপ চা খাওয়াবে। এরা চা-টা ভালো বানায়। আসমানীর মার সঙ্গে সে অতি ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার করবে। কেন সে কাউকে না বলে বাড়ি থেকে চলে গেল, কোথায় গিয়েছিল–এইসব কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। কী দরকার? ফিরে এসেছে এই যথেষ্ট। আল্লাহপাকের দরবারে হাজার শুকুর।
দুপুরের ট্রেনে কোনো যাত্রী নামল না। এটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার। একটা এত বড় ট্রেন–এলো, চলে গেল–একজন যাত্রীও নামল না। এরকম ঘটনা কি আগে কখনো ঘটেছে? মনে হয় ঘটে নাই। স্টেশনমাস্টারকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যাবে। স্টেশনমাস্টারের এইসব হিসাব থাকে। জমির আলী এগিয়ে গেল। কোনো যাত্রী ট্রেন থেকে নামে নি এমন ঘটনা আগে ঘটেছে কি-না তা না জেনে গেলে মনে একটা খুঁতখুঁত থাকবে। জেনে যাওয়াই ভালো।
স্টেশনমাস্টার ধমক দিয়ে জমির আলীকে বিদায় করলেন। গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করে বললেন–যা ভাগ, এক থাপ্পর খাবি।
জমির আলী বিস্মিত হয়ে বলল, থাপ্পর খাওনের মতো অপরাধ কী করলাম? মনের মধ্যে একটা জিজ্ঞাসা ছিল…
আবার কথা বলে! ভাগ!
জমির আলীর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কোনো কারণ ছাড়াই মানুষ এত খারাপ ব্যবহার কী জন্যে করে? ভালো ব্যাবহার করার জন্যে তো টাকা খরচ করা লাগে না। মুখের মিষ্ট কথা নিঃখরচা জিনিস। এক লাখ মিষ্ট কথার দাম শূন্য। জমির আলীর মন এতই খারাপ হলো যে মন খারাপ ভাব কাটাবার জন্যে মিষ্ট কথার সন্ধানে বের হলো। একটা তিক্ত কথা কাটান দিতে একটা মিষ্ট কথা লাগে। তিক্ত কথা কাটান না দেয়া পর্যন্ত মনে অশান্তি থাকবে। কী দরকার মন অশান্ত রেখে! জমির আলী ইয়াকুব সাহেবের সন্ধানে বের হলো।
ইয়াকুব সাহেব কী একটা এনজিওর কাজ নিয়ে এসেছেন। থানা কমপ্লেক্সের পাশে টিনের একচালা ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকেন। অতি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। মধুর ব্যবহার। রমিজ আলীর ধারণা এই মানুষটা শুধু মধুর ব্যবহারের কারণে বেহেশতে যাবে।
খাওয়া-দাওয়ার পর ইয়াকুব সাহেব কিছুক্ষণ ঘুমান। জমির আলী ঠিক করে ফেলল সে যদি গিয়ে দেখে ইয়াকুব সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছেন তাহলেও চলে আসবে না। ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করবে। দুটা মিষ্ট কথা শুনে মনটা ঠিক করবে।
ইয়াকুব সাহেব জেগেই ছিলেন। বারান্দায় রাখা টানা বেঞ্চের এক মাথায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। জমির আলীকে দেখে তিনি হাসিমুখে বললেন, ভিক্ষুক সাহেবের খবর কী? রোজগারপাতি কিছু হয়েছে?
জমির আলীর মন ভালো হয়ে গেল। একে বলে ভদ্রলোক। শরিফ খানদান। জমির আলী বলল, স্যারের শরীরের অবস্থা কী?
অবস্থা ভালোই, তোমার খবর কী? বউ ফিরেছে?
জে-না।
কোথায় আছে খোঁজ-খবর কিছু করেছ?
বাপের বাড়িতে যায় নাই, সে খবর পেয়েছি। মনে হয় সুসং দুর্গাপুরে আছে। তার এক বোনের বিবাহ হয়েছিল সুসং দুর্গাপুরে। আমার বিশ্বাস সেইখানেই আছে।
চলে যাও। বউ নিয়ে আস।
বেকায়দায় পড়ে গেছি স্যার। ঘরে ছোট আবু। কার কাছে রাখি!
তোমার বাচ্চাটা আছে কেমন? কী যেন তার নাম–পয়সা না?
জে স্যার, আপনার দেখি সবই ইয়াদ থাকে।
জমির আলী, দুপুরের খাওয়া হয়েছে? না হয়ে থাকলে অল্প কিছু ভাততরকারি আছে। খেয়ে নাও। খাবে?
জে স্যার।
যাওয়ার সময় থালাবাসন ধুয়ে যেও।
জে আচ্ছা।
জমির আলী মনে মনে বলল, হে আল্লাহপাক! তোমার দরবারে দরখাস্ত করলাম–ইয়াকুব সাহেবরে তুমি বেহেশত নসিব করবে। তাকে বেহশত নসিব না করলে আমি তোমার বেহেশতে ঢুকব না। এইটা আমার ওয়াদা।
জমির আলী যে বেহেশতে যাবে এ বিষয়ে সে নিশ্চিন্ত। কারণ সে স্বপ্নে একবার নবিজিকে দেখেছে। যারা নবিজিকে স্বপ্নে দেখে তাদের বেহেশত নসিব হয়। মুনশি মোল্লার কথা।
খাওয়া-দাওয়ার পর রান্নাঘরেই জমির আলী কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। ভাত ঘুমের মতো আরামের ঘুম আল্লাহপাক তৈরি করেন নাই। ভরপেট খাওয়ার পর বিসমিল্লাহ বলে শুয়ে পড়া। পেট যত ভরা থাকবে ঘুম হবে তত আরামের। ইয়াকুব আলী যদিও বলেছেন–অল্প ভাত তরকারি আছে। ঘটনা ভিন্ন। সব কিছুই পরিমাণ মতো ছিল। ডাল টকে গিয়েছিল, এতে স্বাদ বরং বেড়েছে।
ঘুমের মধ্যে জমির আলী ভালো একটা স্বপ্ন দেখল। আসমানীর মা ফিরে এসেছে। ট্রেন থেকে নামার সময় সে গলা বাড়িয়ে চিৎকার করছে–কুলি! কুলি! এইখানে কুলি আছে? আমার অনেক মাল-সামান। জমির আলী এগিয়ে গেল। আছিয়া তাকে চিনতে পারল না। আলীশান এক ট্রাঙ্ক তার মাথায় তুলে দিল। মাথায় ট্রাঙ্ক, এক হাতে স্যুটকেস, এক হাতে বিরাট এক পুটলি নিয়ে জমির আলী যাচ্ছে। পেছনে পেছনে আছিয়া আসছে। স্বপ্ন বলেই এতগুলি মালসামান নিয়ে এত সহজে হাঁটা যাচ্ছে। জমির আলী বলল, বউ তোমার খবর কী? অমনি আছিয়া রেগে গিয়ে বলল, ঐ ব্যাটা মাডি লাউগরা, তুই আমারে বউ ডাকস কোন সাহসে? লাথ মাইরা তোর কোমর ভাঙব। জমির আলী হাসতে হাসতে বলল, লাথ মার তো! দেখি তোমার ঠ্যাঙে কত জোর! আছিয়া সত্যি সত্যি লাথ মারার জন্যে এগিয়ে এসে জিভে কামড় দিয়ে বলল, ও আল্লা! আপনে? বিরাট অন্যায় করেছি, মাপ দেন। জমির আলী দরাজ গলায় বলল, স্বামী যেমন স্ত্রীর উপর অন্যায় করতে পারে, স্ত্রীও পারে। এতে দোষ হয় না। তারপর বউ বলো—ট্রাঙ্কে কইরা কী আনছ? আছিয়া বলল, টেকা আনছি। ট্রাঙ্ক ভরতি টেকা। আইজ থাইক্যা আপনের ভিক্ষা বন্ধ। ট্রাঙ্ক খুইল্যা টেকা বাইর করবেন আর খরচ করবেন।