আসমানী কলপাড়ে বসল। রমিলা চাচির সঙ্গে গল্প-গুজব করতে তার খুব ভালো লাগে।
রমিলা বলল, চুলে তেল দেস না? চুলে জট পইড়া গেছে। সাবান দিয়া ভালোমতো গোসল দিবি। চুলে তেল দিবি। রাজরানীর মতো চেহারা, ময়লা মাইখ্যা ঘুইরা বেড়াস। ঘরে সাবান আছে?
না।
সাবান নিয়া যাইস। বিকালে আইস্যা সাবান আর মুরগি নিয়া যাবি।
আইচ্ছা।
আসমানী বসে আছে। রমিলা কাপড় ধুচ্ছে। রমিলার চোখে পানি। স্বামীর প্রসঙ্গে কথা বললেই রমিলার চোখে পানি আসে।
রমিলা বলল, চুপচাপ বইস্যা থাকবি না। এখন সামনে থাইক্যা যা। নয়া আবুর কিছু লাগলে আমারে খবর দিস।
আসমানী চলে গেল না। বসে রইল। রমিলা চাচি কাঁদছে। তাকে ফেলে রেখে চলে যেতে আসমানীর খুব মায়া লাগছে।
জামদানী হাঁটুগেড়ে পয়সার কাছে বসে আছে। তার দুধ খাওয়া শেষ হয়েছে। এখন সে হাত-পা ছুঁড়ছে। মাঝখানে সে একবার কান্না থামিয়েছে। জামদানী তার বাবার কাছ থেকে ভিক্ষার গান শিখেছে। টেনে টেনে সুর করে ভালোই গায়। এই ধরনের গানের বিষয়ে জমির আলীর বক্তব্য হলো–ফকিরি গানে এক সঙ্গে তিন কাম হয়–গান গাইয়া আনন্দ, যে শুনে তার আনন্দ, আর গানের মধ্যে আল্লাহ খোদা নবিজির নাম থাকে বিধায় সোয়াবও হয়।
জামদানী বোনকে ফকিরি গান শুনিয়ে কান্না একবার থামিয়েছে। সে মনে হয় আবার কান্না শুরু করবে। মুখ বাকাচ্ছে। জামদানী গান ধরল—
দিনের নবি মুস্তফায়
রাস্তা দিয়া হাইট্যা যায়
একটা পাখি বইস্যা ছিল গাছেরও ছেমায় গো
গাছেরও ছেমায়…
আষাঢ় মাসের কড়া রোদ উঠেছে। কোথাও ছায়া নেই। রোদে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। রোদ মাথায় নিয়ে জমির আলী খেয়াঘাটে বসে আছে। কাছেই বড় ছাতিম গাছ আছে। ছাতিম গাছের নিচে বসলে ছায়া পাওয়া যায়। সেটা করা যাচ্ছে না। যে ভিক্ষুক আরাম করে গাছের ছায়ায় বসে আছে তাকে কেউ ভিক্ষা দেবে না। যে ভিক্ষুক রোদে-পুড়ে কষ্ট করছে তার প্রতি মানুষের দয়া হবে।
রোদে ভাজা ভাজা হয়ে তেমন লাভ হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত জমির আলী মানুষের দয়ার কোনো লক্ষণ দেখছে না। মাঝে মাঝে খারাপ দিন আসে–সারাদিন বসে থেকেও কিছু পাওয়া যায় না। আজ মনে হচ্ছে সে-রকম খারাপ একটা দিন। জমির আলী চিন্তিত বোধ করছে। আধা কেজি চালের পয়সাটা তো উঠা দরকার। বউ চলে যাওয়ায় একটা সুবিধা হয়েছে চালের খরচ কমেছে। এখন আধা কেজি চালে তিনজনের ভালোমতো হয়ে যায়। সব খারাপ জিনিসের মধ্যে আল্লাহপাক ভালো একটা জিনিস ঢুকিয়ে দেন, আবার ভালোর মধ্যে খারাপও ঢুকিয়ে দেন। শুধু মন্দ কিংবা ভালো বলে কিছু তার কাছে নেই।
রোদের কষ্ট ভোলার জন্যে জমির আলী চিন্তা-ভাবনার লাইনে যাবার চেষ্টা করল। কোনো চিন্তা-ভাবনাই পরিষ্কার আসছে না। গরমে সব আউলায়ে যাচ্ছে। জমির আলী আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ ঝকঝকে নীল। মেঘের চিহ্ন মাত্র নেই। ছোটখাট একটা মেঘের টুকরা থাকলেও আশায় আশায় রোদে বসে থাকা যেত–এই মেঘের টুকরা এক সময় বড় হবে। রোদের পাছায় লাথি মেরে রোদ দূর করবে। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় নামবে ঝুম বৃষ্টি।
গরম কাটান দিতে গরম লাগে। আগুন গরম এক কাপ চা খেলে গরম কাটবে। জমির আলী মজিদের চায়ের স্টলের দিকে রওনা হলো। এক সময় মজিদ তার বন্ধু মানুষ ছিল। এক সঙ্গে মাটি কেটেছে। এখন চায়ের স্টল দিয়ে ভদ্রলোক হয়ে গেছে। কাপড়-চোপড় পরে ভদ্রলোকের মতো, কথাবার্তাও বলে ভদ্রলোকের মতো। দোকানে সে একটা সাইনবোর্ডও টানিয়েছে বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না। তারপরেও জমির আলী তার চায়ের স্টলে চা খেতে গেলে সে পয়সা নেয় না। তবে মুখটা গম্ভীর করে রাখে।
মজিদ চায়ের কাপ জমির আলীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, তোমার স্ত্রীর কোনো সন্ধান পেয়েছ? চেহারা ছবি ভালো মেয়ে হারায়ে গেলে খারাপ পাড়ায় দাখিল হয়। ঘণ্টায় দশ টেকা হিসাবে ভাড়া খাটে।
জমির আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। মজিদ তার বন্ধু মানুষ। বন্ধু মানুষ হয়ে বন্ধুর স্ত্রীকে নিয়ে এ ধরনের কথা কী করে বলে? তার কাছে চা খেতে আসাই উচিত না। হাতের চায়ের কাপের গরম চা মজিদের উপর ঢেলে। দিলে ভালো হতো। সেটা উচিত হবে না। একজন মন্দ হলেই যে আরেকজনের মন্দ হতে হবে তা না। জমির আলী চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, তোমার ভাবির খবর পেয়েছি। (সবই মিথ্যা কথা। মান রাখার জন্যে মিথ্যা বলা।) সে সুসং দুর্গাপুরে তার বোনের বাড়িতে আছে। তারা বিরাট বড়লোক। বাজারে টিনের ঘর আছে তিনটা। তারা তোমার ভাবিকে খুবই পেয়ার করে বলে আসতে দেয় না।
মজিদ বিরস গলায় বলল, আসতে না দিলে তোমারই গিয়া নিয়া আসা উচিত। বড়লোকের কায়-কারবার ভিন্ন। দেখা গেল তোমার স্ত্রীর সাথে লটরপটর শুরু কইরা দিছে। কিছুই বলা যায় না, তারে বিবাহও কইরা ফেলতে পারে।
জমির আলী চা শেষ না করেই উঠে পড়ল। বসল আগের জায়গায়। সকালের দিকে কিছু পাওয়া যায় নি। এখন যদি পাওয়া যায়! জমির আলী ঠিক করেছে একটা টাকাও যদি পাওয়া যায় সে টাকাটা দিয়ে আসবে মজিদকে। চায়ের দাম। মজিদকে বলবে–ফকির জমির আলী দয়ার চা খায় না।
সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে। দুপুরের গাড়ি চলে আসার সময় হয়ে এসেছে। এখন জমির আলী যাবে রেলস্টেশনে। যদি পাওয়া যায় তাহলে কুলির কাজ করবে। যাত্রীদের ব্যাগ-সুটকেস নামাবে। আজকাল যাত্রীরাও চালাক হয়ে গেছে। খালি হাতে ঘুরাফিরা করে। ব্রিফকেস হাতে নিয়ে নেমে যায়। দুনিয়াটা চলে যাচ্ছে চালাকের হাতে। বিরাট আফসোস!