একটু পরে পরে কান্দে।
কান্দুক, জন্মের সময় যে সব সন্তান বেশি কান্দে তারা বড় হইয়া এমন সুখে থাকে যে কান্দন কী জিনিস ভুইল্যা যায়। তোর ছোট ভইন বড়ই ভাগ্যবতী। তার ভাইগ্য দেইখা অবাক হইতেছি।
জমির আলী আবারো স্ত্রীর সন্ধানে বের হলো। তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
চুকচুক শব্দ হচ্ছে
চুকচুক শব্দ হচ্ছে।
পয়সা দুধ খাচ্ছে। দুধের বাটিতে কড়ে আঙুল ডুবিয়ে সেই আঙুল ঠোটের কাছে ধরতেই পয়সা আঙুল মুখে নিয়ে চুকচুক শব্দ করছে। বড়ই মজার দৃশ্য। জামাদানীর খুব ইচ্ছা সেও বড়বোনের মতো দুধ খাওয়ায়। কথাটা বলতে কেন জানি তার লজ্জা করছে। তার লজ্জা একটু বেশি; তবে সে মোটামুটি নিশ্চিত আসমানী দয়াপরবশ হয়ে এক সময় বলবে, নে তুই দুধ খাওয়া। জামদানী সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছে।
দুধ খাওয়ানো উৎসব হচ্ছে বাড়ির উঠোনে। অনেক আয়োজন করা হয়েছে। পাটি বিছানো হয়েছে। কাঁথা বালিশ আনা হয়েছে। জলচৌকিতে রাখা হয়েছে দুধের বাটি এবং সরিষার তেলের বাটি। দুধ খাওয়ানো শেষ হলেই পয়সার গায়ে তেল মাখিয়ে রোদে শুইয়ে রাখা হবে। সমস্ত শরীরটা থাকবে। রোদে, শুধু মাথার উপর ছায়া ফেলে একজনকে ছাতা ধরে রাখতে হবে। জমির আলী সেই নির্দেশ দিয়ে গিয়েছে।
আঙুল চুবিয়ে দুধ খাওয়ানোর কৌশলটা আসমানী বের করেছে। আগে ন্যাকড়া দুধে ডুবিয়ে মুখে ধরা হতো। এতে সময় লাগত অনেক বেশি। আঙুল পদ্ধতিতে সময় কম লাগছে। পুরো ব্যাপারটায় আনন্দও আছে। এই আনন্দ স্থায়ী হবে না। জমির আলী বলেছে–এক মাস কষ্ট কর। এক মাস পরে আবু শিশি দিয়া দুধ খাইব। তখন নয়া আবুর মুখে শিশি ধরার কষ্ট ছাড়া আর কষ্ট নাই। তখন খালি আরাম। আসমানী এবং জামদানীর কাছে আঙুল দিয়ে দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারটা কষ্টের না, বরং আনন্দের। এই আনন্দ এক মাসের মধ্যে
শেষ হয়ে যাবে ভাবতে ভালো লাগে না।
জামদানী অনেকক্ষণ হলো চুপচাপ বসে আছে। আসমানী তাকে কিছুই বলছে না। লজ্জা ভেঙে সে নিজেই মিনমিন করে বলল, বুবু, আমি দুধ খাওয়াই?
আসমানী গম্ভীর গলায় বলল, হাত ধুইয়া আয়। ভালোমতো ধুবি।
জামদানী প্রায় দৌড়ে গেল হাত ধুতে। এই ফাঁকে আসমানী তার বোনের সঙ্গে কিছু গল্পগুজব করল–এখন তোমারে কে দুধ খাওয়াইব জানো? তোমার ভইন। তার নাম জামদানী। হে তোমারে খুবই পেয়ার করে। ও আমার পয়সা ভইন, তোমার মনটা খারাপ কেন গো? মার জন্যে পেট পুড়ে? আহারে লক্ষ্মী। আহারে কুটুরা পক্ষী। মা চইল্যা আসব। কয়েকটা দিনের মামলা। মা আইস্যা তোরে কুলে নিয়া খালি হাঁটব, খালি হাঁটব। হাঁটতে হাঁটতে গীত গাইব। গীত শুইন্যা তুই ঘুমাইয়া পড়বি।
বোনের হাতে দায়িত্ব দিয়ে আসমানী উঠে পড়ল। তার অনেক কাজ। কলসিতে খাওয়ার পানি নাই। টিউব কল থেকে জগে করে পানি এনে এনে কলসি ভরতে হবে। তাকে আসা যাওয়া করতে হবে পনের বার। কলসি ভরতে পনের জগ পানি লাগে। সব তার হিসাব করা।
গাঙ্গের পাড়ে কচুগাছে প্রচুর লতি এসেছে। লতি তুলে আনতে হবে। রুস্তমের ভিটার সবরি গাছে সবরির বান ডাকছে। সেইখানে একলা যাওয়া যাবে না। ভয় লাগে। বাপজানকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। জঙ্গলার ভেতর লটকন গাছ ঝেপে লটকন এসেছে। এখনো পাকে নি, তবে পাকার সময় হয়ে এসেছে। রোজ একবার খবর না নিলে পাকা লটকন অন্য কেউ নিয়ে যাবে। জঙ্গলা থেকে খড়ির ব্যবস্থাও করতে হবে। রান্ধাবাড়ার ঝামেলা অবশ্যি নাই। জমির আলী সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে রাঁধতে বসবে। রান্না হয় একবেলা, তাতে কষ্ট হয় না। দুইবোন চিড়া খেয়ে থাকে। চিড়া খুবই গুণের খাদ্য। গুড় দিয়ে দুই মুঠ চিড়া খেয়ে ভরপেট পানি খেলে সারাদিন আর ক্ষিধে লাগে না। ক্ষিধা লাগতে থাকে আছরের পর থেকে। সন্ধ্যাবেলায় ক্ষিধায় চোখ অন্ধকার হয়ে আসে। তখন গরম গরম ভাত কী যে ভালো লাগে!
টিউব কলটা সরকার বাড়ির পিছনে। সরকার বাড়ির বড় বউ রমিলা টিউব কলে কাপড় ধুচ্ছিল। আসমানীকে দেখে বলল, আসমানী, তোর ভইন কেমন আছে?
আসমানী বলল, ভালো। তোর মার কোনো খোঁজ আছে?
না।
সংসার ফালাইয়া তোর মা গেল কই?
আসমানী জবাব দিল না। জবাব দেবার কিছু নেই। তার মা কোথায় গিয়েছে সে জানে না।
তোর বাপও তো বাদাইম্যা। শইল্যে শক্তি আছে, অসুখ নাই বিসুখ নাই–করে ভিক্ষা। এমন মানুষরে কানে ধইরা গেরামের বাইরে বাইর কইরা দেওন। দরকার। ছিঃ ছিঃ!
আসমানীর মনটা খারাপ হলো। তার বাপজানরে কেউ কিছু বললে মন খারাপ লাগে। রাগ হয়। সে রমিলা চাচির উপর রাগ করতে পারছে না। রমিলা চাচি অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। সব সময় তাদের খোঁজখবর করছে। এটা সেটা দিচ্ছে। সে এখন যে হলুদ জামাটা পরে আছে এটাও রমিলা চাচির দেওয়া।
রমিলা বলল, তুই কেমন মেয়েরে আসমানী, তোর বাপরে নিয়া দুইটা মন্দ কথা বললাম সাথে সাথে মুখ কালা। যে মন্দ তারে মন্দ বলব না?
আসমানী নিচু গলায় বলল, বাপজান মন্দ না।
রমিলা হাসি মুখে বলল, আচ্ছা যা তোর বাপজান মন্দ না। হে রসগোল্লা। রসের মইধ্যে ডুইব্যা আছে। কি খুশি হইছস?
আসমানী কিছু বলল না। রমিলা বলল, একটা মুরগি ছদগা দিছি। মনে কইরা নিয়া যাবি।
ছদগা কী জন্যে দিছেন? বিপদ আপদ হইছে?
রমিলা বিষণ্ণ গলায় বলল, তোর চাচা থাকে বৈদেশে। তার জন্যে মনটা সব সময় খারাপ থাকে। তার যেন বিপদ আপদ না হয় এই জন্যে ছদগা দিলাম। গত রাইত একটা খারাপ খোয়াবও দেখছি। মনটা পেরেশান। খোয়াবে দেখলাম তোর চাচা সাদা চাদ্দর গায়ে দিয়া বিছানায় শুইয়া আছে। একটু পরে পরে বলতেছে–বৌ, আমারে পানি দেও। বড় তিয়াস লাগছে। আমি পাগলের মতো পানি খুঁজতেছি। পানি পাইতেছি না। সবই আছে, পানি নাই। তখন ঘুম ভাঙ্গছে, সারা রাইত আর ঘুম হয় নাই।