জমির আলী বলল, কোনো চিন্তা করিস না। আমরার সাথে ছোট শিশু আছে। ছোট শিশু ফিরিশতার সামিল। ফিরিশতার বিপদ-আপদ নাই।
আসমানী বলল, কেরামত চাচার বাড়িত যাইবা?
জমির আলী বলল, মনে হয় যাইতে হবে। তোর মারে বল।… আচ্ছা আমিই বলব। ঝড়-তুফানরে সমীহ করা লাগে। ঝড়-তুফান কারোর খালাতো ভাই মামাতো ভাই না।
আছিয়া বলল, আপনের যেইখানে ইচ্ছা সেইখানে যান। গুষ্ঠী সাথে লইয়া যান। আমি যাব না।
জমির আলী চিন্তিত মুখে বলল, ঘর-বাড়ি তো পইড়া যাইতেছে। যাউক পইড়া।
সত্যি যাইবা না?
না।
বউ তোমারে আল্লাহর দোহাই লাগে।
আফনেরে আল্লাহর দোহাই লাগে কানের কাছে ভ্যানভ্যান কইরেন না।
ঝড় প্রবল হয়েছে। বাড়ির চালার একটা অংশ উড়ে চলে গেল। আসমানী এবং জামদানী দুদিক থেকে বাবাকে জাপ্টে ধরে আছে। জমির আলী শিশু সন্তানটিকে কথায় মুড়ে বুকের কাছে দুহাতে ধরে রেখেছে। ঝড়-ঝঞার জন্যই হোক বা পরিশ্রান্ত হবার কারণেই হোক সে কাঁদছে না। জমির আলী বলল, চল রওনা দেই। দুইজন আমারে শক্ত কইরা ধর। মনে মনে নুহ নবির নাম নে। ঝড়-তুফানের সময় নুহ নবির নাম খুব কামে দেয়।
আসমানী বলল, তুমি অত কিছু জান ক্যামনে?
আছিয়া তিক্ত গলায় বলল, তোর বাপ বিরাট তালেবর বিদ্যার মটকি। হে জানব না তো কে জানব? যা বাপের সাথে যা। পথে পিছলাইয়া পইড়া পাও ভাঙ। এক আধজন লুলা হইলে সুবিধা আছে। ভিক্ষা বেশি পাওন যাইব।
ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকের আলো দেখে দেখে এগুতে হচ্ছে। এমিতে চারদিক ঘন অন্ধকার। বৃষ্টির পানি বরফ শীতল। বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ। বৃষ্টির পানিতে পিছল হয়ে আছে। বুড়ো আঙুলটি টিপে টিপে খুব সাবধানে এগুতে হচ্ছে। ঝড় এমন ঝাপটা দিচ্ছে যে জমির আলীর মনে হচ্ছে, তার দুটি মেয়ের একটিকে বুঝি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জমির আলী বলল, শক্ত কইরা ধইরা থাক। প্রয়োজনে পাও ধইরা ঝুইলা পড়। মনে মনে বল–লাইলাহা ইল্লাল্লাহ।
পথের উপর বাঁশঝাড়ের বাঁশ ভেঙে পড়েছে। ডিঙিয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। বাঁ দিকের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে কিছুদূর যাওয়া যাবে, সেটিও বিপদজনক। রুস্তমের ভিটার উপর দিয়ে যেতে হবে। রুস্তমের ভিটার উপর দিয়ে দিনমানেও কেউ যায় না। ঝড়-বৃষ্টির নিশুতি রাতে অভিশপ্ত ভিটার ধারেকাছে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। হয়তো দেখা যাবে উঁচু ভিটার উপর সাদা থান পরা রুস্তমের দাদি বসে আছে। বহুঁ বছর আগে মৃত এই খুনখুনি বুড়িকে দেখে নাই এমন লোকের সংখ্যা এই গ্রামে খুবই কম। বুড়ি ভিটার উপর বসে পান খায়। পানের পিক ফেলে। পিকের বর্ণ টকটকে লাল। মনে হয় যেন পিক না–তাজা রক্ত।
মনের ভুলে রাতে বিরাতে কেউ যদি রুস্তমের ভিটার পাশ দিয়ে যায় তাহলেই বুড়ি মধুর গলায় ডাকবে–যায় কেডা? বদরুলের বেটা ছদরুল? কেমন আছসরে ভাইটি? আয় কাছে আয়, পান খাইয়া যা। মনের ভুলে কেউ যদি বুড়ির সঙ্গে গল্পগুজব শুরু করে তাহলেই সর্বনাশ। সে বাড়ি ফিরে আসবে প্রবল জ্বর নিয়ে। খিচুনি শুরু হবে। মুখ দিয়ে গেজলা বেরুবে। ডাক্তার-কবিরাজ করার আগেই শেষ। এই গ্রামের দুইজন আর ভিনদেশী একজন এইভাবে শেষ হয়েছে।
জমির আলী ভীত গলায় বলল, আসমানী জামদানী, আমরা রুস্তম আলীর ভিটার উপর দিয়া যাব। বুড়িরে যদি দেখস ভয় খাইস না। আর বুড়ির কোনো কথার জবাব দিবি না। খবরদার কইলাম। আমি মনে মনে আয়াতুল কুরশি পড়তে থাকব। ভয়ের কিছু নাই। আয়াতুল কুরশির কাছে কেউ ভিড়তে পারে না। বড় শক্ত সূরা। জীন-ভূতের জন্যে কোরামিন ইনজেকশন।
আসমানী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আইচ্ছা।
আয়াতুল কুরশি পড়ার ব্যাপারটা জমির আলী মেয়েদের সাহস দেবার জন্যে বলেছে। আয়াতুল কুরশি সে জানে না। আল্লাহর পাক কালাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলা মহাঅপরাধ। মেয়ে দুটিকে সাহস দেবার জন্যে জমির আলী এত বড় অপরাধ করল। মেয়েরা সাহস পেল কি-না বুঝা গেল না, তবে ভয়ে জমির আলীর বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। সে নিশ্চিত রুস্তম আলীর দাদিকে দেখা যাবেই। বুড়ি পানের পিক ফেলতে ফেলতে মধুর গলায় বলবে–কে যায়? আমরার ফকির জমির আলী না? ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে তিন কইন্যা লইয়া কই যাস? একটারে আমার কাছে থুইয়া যা। আদর কইরা পালব।
মেয়ে তিনটিকে কেরামতের পাকাবাড়ির বারান্দায় রেখে জমির আলী আবার বের হলো। আছিয়ার খোঁজ নেয়া দরকার। রাগ ভাঙায়ে তাকে নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে কোলে করে আনতে হবে। স্ত্রী স্বামীকে কোলে নিতে পারে না, তবে স্বামী স্ত্রীকে কোলে নিতে পারে। তাতে দোষ হয় না।
আছিয়াকে পাওয়া গেল না। সে উঠানে বসে নেই। ঘরের ভেতরে নেই। আশেপাশে কোথাও নেই। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে অসুস্থ মানুষটা যাবে কোথায়? এমন কি হতে পারে মেয়ে তিনটার টানে সে ঘুরপথে কেরামতের পাকা দালানে উপস্থিত হয়েছে! সন্তানের টান বড় মারাত্মক টান। লোহার শিকলের টান। জমির আলী আবারো কেরামতের বাড়িতে উপস্থিত হলো।
দুই বোনই জড়সড় হয়ে উঠানে বসে আছে। আসমানীর কোলে পয়সা। সে কুঁকুঁ শব্দ করছে। দুটি মেয়েই শীতে কাঁপছে। কেরামত দরজা খুলে মেয়েগুলিকে ভিতরে ঢুকতে দেয় নি। আসমানী বলল, বাপজান, মা কই?
জমির তখন বলল, এখনো খুঁজতে যাই নাই, তরার কী অবস্থা দেখতে আসছি। অবস্থা কী?
আসমানী বলল, শীত লাগে।
ভিজা কাপড়ে শীত তো লাগবই। তোরা টাইট হইয়া বইয়া থাক। তোর মারে নিয়া আসতাছি। নয়া আবুর খবর কী?