তৈয়ব বলল, এই কাজ তো আমি করব না। আমি যার নুন খেয়েছি মরার আগের দিনও তার গুণ গাইব। আপনি যদি সার্কাস কিনতে চান তাহলে এই তিনবোনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
বশির মোল্লা সিগারেট হাতে একদৃষ্টিতে তৈয়বের দিকে তাকিয়ে আছে। তৈয়ব বলল, আপনি এইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন যেন আমার মতো মানুষ আগে দেখেন নাই।
বশির মোল্লা জবাব দিলেন না। চোখ ফিরিয়ে নিলেন না। তৈয়ব বলল, আপনার বিরাট ব্যবসা-বাণিজ্য। অনেক লোকজন আপনার জন্যে খাটে। এদের মধ্যে আমার মতো দুই চারজন অবশ্যই আছে। যারা মালিকের জন্যে জীবন দিয়ে দিবে। আছে না?
হুঁ আছে।
স্যার আমি উঠি?
বশির মোল্লা জবাব দিলেন না। তৈয়ব বলল, মালিকানা বদলের পর আজ প্রথম শো। স্যার যদি সময় হয় চলে আসবেন। আপনার জন্যে একটা পাস নিয়ে এসেছি। তৈয়ব আলী পাঞ্জাবির পকেট থেকে পাস বের করল। বশির মোল্লা হাত বাড়িয়ে পাস নিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দড়ির খেলা
কিছুক্ষণের মধ্যেই দড়ির খেলা শুরু হবে। তিনবোন গ্রিন রুমে বসে আছে। তিনজনই কাঁদছে। হারুন সরকার কখনো তাদের খুব কাছের মানুষ ছিল না। মানুষটা মারা যাবার পর তাদের কাছে মনে হচ্ছে মানুষটা আসলে খুব কাছের ছিল। সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে তাদের আড়াল করে রেখেছিল। তাদের কখনোই কোনো সমস্যা হয় নি। সার্কাসের মেয়েদের সার্কাসের বাইরেও অনেক। কুৎসিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে হয়। তাদের কখনো হতে হয় নি।
ঘণ্টা বেজে গেছে। এক্ষুণি তাদের স্টেজে ঢুকতে হবে। জামদানী বড় বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, বুব, আজ একসিডেন্ট হবে। আমার পা কাঁপছে। আমি মাটির উপর দাঁড়াতে পারছি না। দড়ির উপর কীভাবে দাঁড়াব? বুবু, ম্যানেজার সাহেবকে বলো— আজকের শোটায় আমরা থাকব না। আজ অবশ্যই একসিডেন্ট হবে। পা পিছলে আমি পড়ব। আমি পড়ে গেলে তোমরাও পড়ে যাবে।
ম্যানেজার তৈয়ব আলী ঘরে ঢুকল।
কঠিন গলায় বলল, দেরি হচ্ছে কেন?
জামদানী বলল, আজ আমার পা কাঁপছে।
তৈয়ব বলল, কোনো ফাজলামি কথা আমি শুনতে চাই না। এক্ষুণি দড়িতে গিয়ে উঠ।
একসিডেন্ট হলে?
একসিডেন্ট হলে হবে। শো শুরু হয়েছে শো বন্ধ হবে না। এক মিনিটের মধ্যেই আমি তিনজনকে দড়ির উপর দেখতে চাই।
তিনবোন দড়ির উপর উঠে এসেছে। তিনজনেরই পা টলমল করছে। সবচে’ বেশি করছে জামদানীর। তৈয়ব আলী তাঁবুর বাইরে এসে সিগারেট ধরাল। সার্কাসের মালিকানা হস্তান্তরের খবর তিনবোনকে এখনো দেয়া হয় নি। শোর শেষে দেয়া হবে। তিন বোনকে সে বলবে তারা যদি চায় তাহলে ম্যানেজারের দায়িত্ব সে পালন করবে। যদি না চায় সে দেশের বাড়িতে চলে যাবে। বিশ্রাম করবে। সার্কাসের ম্যানেজারি খুবই টেনশানের কাজ। এত টেনশন সে নিতে পারছে না।
তাঁবু ভর্তি মানুষ। এরা মুগ্ধ হয়ে দড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তিনবোনের একজন মনে হচ্ছে বারবার দড়ি থেকে পড়ে যাচ্ছে। একবার তো এমন হলো ছোট মেয়েটা বিদ্যুতের মতো এসে একজনকে ধরল। ছিটকে নিচে পড়া থেকে বাঁচল।
নি পোর্টার হাসিমুখে ভিডিও করছে। আজ সে নিচ্ছে দর্শকদের রিএকশান। আজ তার কাছে মনে হচ্ছে সার্কাসের মেয়ে তিনটির খেলার চেয়েও অনেক মজা দর্শকদের রিএকশন দেখা।
নি পোর্টারের চেয়ারের পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক বলল– ও আল্লা, কইলজা কাঁপতাছে। পইড়া যাইব তো।
নি পোর্টার বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল–আপনি ভয় পাবেন না। ওরা এক্সপার্ট। ওরা দড়ি থেকে পড়বে না। ওরা দড়ি থেকে পড়ে যাবার অভিনয় করছে।
বৃদ্ধ বলল–জনাব, ভয় কাটতাছে না। আমি সমানে দোয়া দুরুদ পড়তেছি। আমি এরার পিতা। এরার মাতাকে সন্ধান করতে করতে এখানে এসেছি। সবচে বড় যে মেয়েটা দেখতেছেন–তার নাম আসমানী বেগম। মেজোটার নাম জামদানী বেগম। সবচে ছোটটার নাম–মোসাম্মত পয়সা কুমারী। জনাব কী করি বলেন, বড় ভয় লাগতাছে।
নি পোর্টার বৃদ্ধের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধ দুহাতে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে।
দর্শকদের ভেতর তুমুল উত্তেজনা। এখন শুরু হয়েছে সবচে ভয়ঙ্কর অংশ–দড়ির উপর দিয়ে ছোটাছুটি করা। সবচে ছোটমেয়েটা একা দড়ির উপর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। এক মাথায় যাচ্ছে। নিমিষের মধ্যে অন্য মাথায় চলে আসছে। সার্কাসের ব্যান্ড তুমুল বাদ্য বাজাচ্ছে।
জমির আলী বিড়বিড় করে বলছে–আম্মাজি। মোসাম্মত পয়সা কুমারী। নাইম্যা আস। আমার বড় ভয় লাগতাছে গো মা।