যাদু সম্রাট প্রফেসর মতিনের মুখ হা হয়ে গেল। বশির মোল্লা আড় চোখে মতিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। যাদু সম্রাটের বিস্মিত মুখ দেখতে ভালো লাগছে। মিথ্যা কথাটা এই গাধা ম্যাজিশিয়ান ধরতে পারছে না। সত্যি ভেবে নিয়েছে। বশির মোল্লা হাই তুলতে তুলতে বললেন, সার্কাসের দলটার যে হাত বদল হয়েছে তা জানেন না?
না।
তৈয়ব কিছু বলে নাই?
না। ম্যানেজার সাহেব অবশ্য কখনো কিছু বলেন না। আপনি কি সত্যই স্বাধীন বাংলা সার্কাস কিনেছেন?
হুঁ।
কত টাকা দিয়ে কিনেছেন?
কত টাকা দিয়ে কিনেছি সেটা তোমাকে বলব কেন? তুমি আমার কর্মচারী, এর বেশি কিছু তো না। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ আপনি আপনি করেছি। এখন থেকে আর করব না। আমি আমার কোনো কর্মচারীর সঙ্গে আপনি আপনি করি না। এখনো দাঁড়ায়ে আছ কেন? বসো।
যাদু সম্রাট বসল। বশির মোল্লা গলা নামিয়ে বললেন, সার্কাসের ভেতরের খবর কিছু দাও দেখি।
মতিন শুকনো গলায় বলল, ভেতরের কোন খবর?
মেয়ে তিনটা সম্পর্কে বলো। এরা কি বাইরে ভাড়া খাটে?
মতিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। বশির মোল্লা বললেন, সার্কাসের কোনো লোকের সঙ্গে মেয়েগুলির লটপটি আছে?
মতিন তাকিয়ে আছে। কী বলবে কিছুই তার মাথায় আসছে না। কী অদ্ভুত মানুষ। এই মানুষটা কি সত্যি সত্যি সার্কাস কিনে নিয়েছে?
বশির মোল্লা বললেন, যাদু সম্রাট, তোমার পয়সা গিলে খাওয়ার ম্যাজিকটা কী ভাবে কর? পয়সা হাতের তালুতে লুকায়ে রাখ?
জি।
কীভাবে লুকায়ে রাখ আমাকে শিখায়ে দাও।
একদিনে শিখা যাবে না। পামিং বছরের পর বছর শিখতে হয়। আমি ওস্তাদের কাছে পামিং শিখেছি চার বছর।
তুমি বেকুব মানুষ। তোমার তো সময় বেশি লাগবেই। আমি তো তোমার মতো বেকুব না। আমি তাড়াতাড়ি শিখব। পয়সা কীভাবে লুকায় শিখাও দেখি।
বশির মোল্লা তার থাবার মতো হাত মেলে ধরলেন।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বশির মোল্লা একা একা তার ঘরেই বসা। ঠিক আগের জায়গাতেই বসা। তিনি হাতের তালুতে পয়সা নিয়ে পামিং প্র্যাকটিস করেই যাচ্ছেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এর কৌশল এখন তার আয়ত্বে। মাঝে মধ্যে হাতের তালু থেকে পয়সা খসে যাচ্ছে, তবে বেশির ভাগ সময় লেগে থাকছে। পয়সা গিলে খাওয়ার খেলাটা বশির মোল্লা এখন ইচ্ছা করলেই দেখাতে পারবে। তার খেলা যাদু সম্রাট মতিনের মতো ভালো না হলেও খুব খারাপ হবে না।
বশির মোল্লা অপেক্ষা করছেন। তৈয়বের জন্যে অপেক্ষা। তৈয়বকে এখানে আসার জন্যে কোনো খবর পাঠানো হয় নি, তবে সে যে আসবে এটা নিশ্চিত। যাদু সম্রাট মতিন সার্কাস বিক্রির খবর ছড়িয়ে দেবে। তৈয়বের মতো বুদ্ধিমান লোক এই ধরনের গুজবের রহস্য ধরতে পারবে না তা হয় না। সে আসবেই। সে যদি বুদ্ধিমান হয় মেয়ে তিনটাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। বিনয়ী গলায় বলবে–স্যারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তিনবোনকে সঙ্গে আনলাম। স্যার। বলেছিলেন এদের সঙ্গে কথা বলতে চান। আর যদি তৈয়বকে যতটা বুদ্ধিমান মনে করা হয়েছে ততটা বুদ্ধিমান সে না হয় তখন সে কী করবে?
ঘর অন্ধকার। বশির মোল্লা নিবিষ্ট মনে হাতের তালুতে পয়সা লুকানোর প্র্যাকটিস করে যাচ্ছেন।
মাগরেবের আজানের পর পরই তৈয়ব আলী ভিজতে ভিজতে এমভি সওদাগর লঞ্চে উঠে এলো। তার মুখ শান্ত। চলাফেরায় কোনো জড়তা নেই।
বশির মোল্লা আনন্দিত গলায় বললেন, তৈয়ব আস। আস। তোমার জন্যে অপেক্ষা। আমার দিকে তাকায়ে দেখ পুরোপুরি নেংটা হয়ে অপেক্ষা করছি। হা হা হা।
তৈয়ব বশির মোল্লার সামনে বসেছে। তার চোখে-মুখে কোনো বিকার নেই। তাকে দেখে মনে হচ্ছে নেংটা পুরুষ মানুষের সামনে বসে তার অভ্যাস আছে।
বশির মোল্লা বললেন, তুমি যে চলে এলে আজ তোমাদের খেলা নাই।
তৈয়ব বলল, আজ একটু দেরিতে শুরু হবে। রাত আটটায়।
রাত আটটায় কেন?
শেষ শো, এই জন্যে রাত আটটা।
মাইকে বলছিল আরো এক সপ্তাহ চলবে।
তৈয়ব বলল, একটা ঝামেলা হয়ে গেল।
বশির মোল্লা আগ্রহী গলায় বললেন, কী ঝামেলা?
আমাদের মালিক হারুন সরকার মারা গেছেন।
বলো কী? কখন মারা গেলেন?
বিকেলে।
উনার ওয়ারিশান কে?
উনি বিবাহ করেন নাই। উনার আত্মীয়স্বজন কেউ নাই।
তাহলে সার্কাসের মালিকানা এখন কার?
তৈয়ব জবাব দিল না। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করে সিগারেট ধরাল। বশির মোল্লা বললেন, আমার ধারণা সার্কাস এখন তোমার হাতে। আমার ধারণা কি ঠিক আছে?
তৈয়ব সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, সার্কাস আগে আমিই দেখতাম, এখনো আমি দেখব। তবে সার্কাসের মালিকানা আমার না। হারুন সরকার সার্কাসের মালিকানা তিনবোনকে দিয়ে গেছেন।
বশির মোল্লা বললেন, কেন?
তৈয়ব বলল–কেন সেটাই তো আমি জানি না। হারুন সরকার জানতেন। উনাকে জিজ্ঞেস করে এখন আর জানা যাবে না। তবে মেয়ে তিনটাকে খুব ছোটবেলায় উনি নিয়ে এসেছিলেন। খুবই আদর করতেন।
মেয়েরা জানে যে সার্কাসের মালিকানা তাদের?
না জানে না। এখনো কিছু বলি নাই।
অতি উত্তম কাজ করেছ। সার্কাস যে উনি দিয়ে গেছেন–মুখে মুখে। দিয়েছেন না-কি কাগজপত্র আছে?
স্ট্যাম্প পেপারে দলিল করে দিয়েছেন।
দলিল তোমার কাছে?
জি।
সঙ্গে আছে?
না সঙ্গে নাই।
বশির মোল্লা সিগারেটের জন্য তৈয়বের কাছে হাত বাড়ালেন। তৈয়ব তাকে সিগারেট দিল। বশির মোল্লা সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, দলিল ছিড়ে ফেল।