আরো একটি বিশেষ কারণে বশির মোল্লার মন ভালো সার্কাসের ছোট মেয়েটিকে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। দড়ির উপর অনেক দূর থেকে দেখে মেয়েটাকে যত সুন্দর লেগেছে, কাছ থেকে আরো বেশি সুন্দর লেগেছে। সাধারণত উল্টা হয়। দূর থেকে যাদের সুন্দর লাগে, কাছে আর সুন্দর লাগে না। গতকাল মেয়েটার গলায় সোনার মেডেল পরিয়ে হাতে দশ হাজার টাকা দিতে দিতে বললেন তোমার নাম কী গো? মেয়েটা হেসে দিয়ে বলল–নাম তো জানেন। আবার কেন জিজ্ঞেস করছেন? বশির মোল্লা বললেন, প্রত্যেকে তার নিজের নামটা মধুর করে বলে। তুমি কত মধুর করে বলো এটা শোনার জন্যে নাম জিজ্ঞেস করলাম। মেয়েটা তার কাছ থেকে এ ধরনের কথা শুনবে বলে আশা করে নি। মেয়েটার চোখের উপর দিয়ে বিস্ময় ঝিলিক মেরে গেল। বিস্ময়টা বশির মোল্লার ভালো লাগল। এই মেয়ে আশেপাশে থাকলে তার বিস্মিত চোখ ঘনঘন দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে। তিনি এখন তার চারপাশে ভীত চোখ দেখেন। বিস্মিত চোখ দেখেন না।
বশির মোল্লা ঘড়ি দেখলেন। এগারোটা বাজে। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি বাদল হবে বলে মনে হয়। গা ভর্তি ঘামাচি হয়েছে। বৃষ্টিতে না ভিজলে ঘামাচি দূর হবে না। অবশ্যি ঘামাচির একটা উপকারিতা আছে। নখ দিয়ে কেউ যখন ঘামাচি মারে তখন খুবই আরাম লাগে। গা ভর্তি ঘামাচি নিয়ে তিনি বসে আছেন। তাকে ঘিরে তিন বোন বসে আছে। ঘামাচি মারছে। ভাবতেও ভালো লাগছে। পৃথিবীর কোনো মেয়ের সঙ্গে কোনো মেয়ের মিল থাকে না। কাজেই তিন বোন তিনভাবে ঘামাচি মারবে। সবচে ভালো করে যে ঘামাচি মারবে তাকে আধাভরি ওজনের একটা মেডেলও দেয়া হবে। মেডেলে লেখা থাকবে–ঘামাচি রানী।
বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। বশির মোল্লা বৃষ্টিতে ভেজার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে লঞ্চে নিজের ঘরে বসে রইলেন। তার গায়ে কোনো কাপড় নেই। ঘিয়া রঙের একটা চাদর কোমরের কাছে ফেলে রাখা। ইদানীং তার সমস্যা হয়েছে কাপড় গায়ে রাখতে পারেন না। গা কুটকুট করে। সমস্যাটা আগে গরমের সময় হতো। এখন সারা বছরই হয়। বাইরে ঘোরাঘুরি করা এই কারণেই দ্রুত কমে আসছে। তিনি বেশির ভাগ সময়ই নিজের ঘরে বসে থাকেন। কোমরের কাছে পাতলা চাদর দেয়া থাকে। সব সময় যে থাকে তাও না। বেশির ভাগ সময়ই থাকে না। আজ চাদরে নিজেকে খানিকটা ঢেকে রেখেছেন কারণ সার্কাসের ম্যাজেশিয়ান ব্যাটাকে আসতে বলেছেন। তিনি তার কাছ থেকে ভেতরের সংবাদ কিছু সংগ্রহ করবেন। মোটামুটি ভাবে যা জানার সবই জানা হয়েছে। তারপরেও ভেতরের কিছু খবরাখবর দরকার। তৈয়ব নামের ম্যানেজার অতিরিক্ত চালাক। তার চালাকি সামলে দিতে হলেও ভেতরের কিছু তথ্য দরকার। তৈয়বের পেছনে তিনি সর্বক্ষণের জন্যে একজন লোক লাগিয়ে রেখেছেন। সেই লোক যে খবর দিয়েছে তা বিস্ময়কর। তৈয়ব দুটা সাতটনি ট্রাক ভাড়া করেছে। ট্রাক দুটা রাত একটায় সার্কাসের মাঠে যাবে। দলবল নিয়ে পালিয়ে যাবার মতলব না তো? এদিকে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে আরো সাত দিন সার্কাস চলবে। তৈয়ব কোনো একটা চাল চালার চেষ্টা করছে। চালটা বশির মোল্লা ধরার চেষ্টা করছেন। তিনি রাগ করছেন না, আবার বিরক্তও হচ্ছেন না। বরং মজা লাগছে। বুদ্ধির খেলা খেলতে তাঁর সব সময় ভালো লাগে। সমস্যা একটাই–বুদ্ধির খেলা খেলার মতো মানুষের সঙ্গে তার দেখা আজকাল হয় না।
পৃথিবীতে চার রকমের খেলা আছে—
১. জ্ঞানের খেলা
২. বুদ্ধির খেলা
৩. টাকার খেলা।
৪. সাপের খেলা।
এরমধ্যে সবচে সহজ খেলা টাকার খেলা। এই খেলা নির্ভর করে টাকার পরিমাণের উপর। যার যত বেশি টাকা এই খেলা সে তত ভালো খেলে। সবচে কঠিন খেলা হলো বুদ্ধির খেলা। কঠিন খেলা বলেই এই খেলায় আনন্দও বেশি।
সার্কাসের ম্যাজেশিয়ান মতিন চলে এসেছে। বশির মোল্লা তাকে সরাসরি তার পর্দায় ঢাকা খাস কামরায় ডেকে পাঠালেন। তার কোমরে ফেলে রাখা ঘিয়া রঙের চাদরটা দূরে সরিয়ে দিলেন। মতিন বাবাজি ম্যাজিক দেখিয়ে লোকজনদের চমকে দেয়। তিনিও ব্যাটাকে চমকে দেবেন। ম্যাজিক ছাড়াই চমক। ব্যাটা ঘরে ঢুকেই দেখবে কুচকুচে কালো দুই মনি এক নেংটা বাবা গম্ভীর মুখে বসে আছে। যে ম্যাজিক দেখিয়ে লোকজনের চোখ কপালে তুলে দেয় তার নিজের চোখ কপালে উঠে যাবে। ম্যাজিশিয়ান মতিনের চোখ সত্যি সত্যি কপালে উঠে গেল। বশির মোল্লা নরম গলায় বললেন–ভাই, কিছু মনে করবেন না। গরম বেশি পড়ছে। এই জন্যে নেংটা হয়ে বসে আছি। বৃষ্টি পড়া অবশ্য শুরু হয়েছে। আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ঠাণ্ডা হলেই গায়ে চাদর দিব। আপনার অসুবিধা হলে নিচে তাকাবেন না। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন। আপনার নাম যেন কী?
প্রফেসর মতিন। যাদু সম্রাট প্রফেসর মতিন।
যাদু সম্রাট কবে হয়েছেন? কেউ বানিয়েছে না নিজে নিজে হয়েছেন? সকালে ঘুম ভাঙার পরে সবাইরে ডেকে বললেন আমি যাদু সম্রাট।
মতিন মেজাজ খারাপ করে তাকিয়ে আছে। লোকটা কেন তাকে ডেকে পাঠিয়েছে, কেনই বা নেংটা হয়ে বসে আছে–কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
যাদু সম্রাট, দাঁড়ায়ে আছেন কেন? বসেন। না-কি নেংটা মানুষের সঙ্গে বসতে অসুবিধা আছে?
মতিন বিরক্ত গলায় বলল, আমার কাজ আছে। কী জন্যে ডেকেছেন বলেন।
বশির মোল্লা ঘিয়া রঙের চাদর দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন–এত টাকা খরচ করে সার্কাসের দলটা কিনলাম। তাদের লোকজন কেমন জানার কাজেই আপনাকে ডেকেছি।