ডাক্তার কিছু বলল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
কেউ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে বশির মোল্লার ভালো লাগে। আবার কেউ ভয় পেয়ে তাকিয়ে থাকলেও ভালো লাগে। বিস্মিত মানুষ এবং ভীত মানুষ–দুই ধরনের মানুষই তার দেখতে ভালো লাগে। কোন ধরনের মানুষ দেখতে বেশি ভালো লাগে এখনো তিনি বুঝে উঠতে পারেন নি।
সুনামগঞ্জ থেকে একবার এক ফিসারিজের অফিসার জলমহল দেখতে তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন। অল্পবয়স্ক রূপবতী স্ত্রী। হাতে ক্যামেরা। যা দেখছে লাফালাফি করে তারই ছবি তুলছে। ফিসারিজ অফিসারের নাম রকিবউদ্দিন। স্ত্রীর সাথে তিনিও লাফালাফি করছেন। স্ত্রীর শাড়ির পাড়ে কাদা লেগেছে। রকিব উদ্দিন নিজেই সাবান দিয়ে শাড়ির পাড় ধুচ্ছেন। তবে স্ত্রীকে নিয়ে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করলেও তালে ঠিকই আছে। এরই মধ্যে এক ফাঁকে ঘুসের টাকাটা দিয়ে দিতে বলেছেন। মাসের এক-দুই তারিখে টাকাটা পৌঁছে দেয়া হয়। এবার তিনি নিজেই হাতে হাতে নিয়ে যাবেন। এবং ফেরার পথে একটা বড় রুই মাছ,
একটা বোয়াল মাছ এবং এক কলসি কৈ মাছ দিয়ে দিতে বলেছে।
বশির মোল্লা বললেন, বিশাল সাইজের পাবদা আছে। কিছু পাবদাও নিয়ে যান।
রকিবউদ্দিন বললেন, পাবদা আমার স্ত্রী খায় না। মাছের ব্যাপারে সে খুব চুজি।
ম্যাডাম না খেলে না খাবেন। আপনি খাবেন। পাবদার সাইজ দেখার মতো। এক একটা এক হাত লম্বা। কিছু দিয়ে দেই?
রকিবউদ্দিন যেন নিতান্তই অনিচ্ছায় বললেন, তাহলে দেন।
বড় মাছ একটা করে দিতে বলেছেন, দুটা করে দিয়ে দিলাম। একটা করে মাছ দেওয়া ঠিক না। অলক্ষণ।
এত মাছ করব কী?
নিজে খাবেন। আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশীকে দিবেন।
অত্যন্ত আনন্দিত মুখে রকিবউদ্দিন নৌকায় উঠতে যাবেন, বশির মোল্লা বলল, স্যারের সঙ্গে একটু প্রাইভেট টক ছিল।
রকিবউদ্দিন বললেন, বলুন কী ব্যাপার?
বশির মোল্লা বললেন, স্যারের স্ত্রী মাশাল্লাহ সুন্দরী।
রকিবউদ্দিন চোখ সরু করে তাকালেন। তাঁর মুখের চামড়া সামান্য শক্ত হয়ে গেল। হঠাৎ তাঁর স্ত্রীর প্রসঙ্গ কেন এলো ভদ্রলোক বুঝতে পারছেন না।
বশির মোল্লা গলা নিচু করে বললেন, আমি মনস্থির করেছি আপনাদের দুজনকে আজ রাতে আমার বাংলোবাড়িতে রেখে দেব। দোতলা বাড়ি। জেনারেটর আছে। ফ্যান বাতি সবই চলে। আপনি থাকবেন একতলায়। ম্যাডামকে নিয়ে আমি থাকব দুতলায়।
রকিবউদ্দিন হতভম্ব গলায় বললেন, তার মানে? তার মানে কী?
বশির মোল্লা গলা আরো নিচু করে বললেন, মানে তো পরিষ্কার। এরচে পরিষ্কার আর কীভাবে বলি? এরচে পরিষ্কার করে বললে শুনতে খারাপ লাগবে। আমার অবশ্যি বলতে অসুবিধা নাই। আমি মেছুয়া মানুষ। আমি ভালো-মন্দের ধার ধারি না।
রকিবউদ্দিন কঠিন দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। তিনি সঙ্গে করে যে দুজন পিয়ন এনেছিলেন, তাদের খুঁজছেন। তবে তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। বশির মোল্লা বললেন, আপনার দুই পিয়নকে সকালে নৌকায় করে মাছ দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।
রকিবউদ্দিন রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আপনি নিজেকে কী ভাবেন? দেশে আইন-কানুন নাই?
বশির মোল্লা বললেন, ভাটি অঞ্চলে আমিই আইন, আমিই কানুন। আমি কী বলি শুনেন। ঝামেলা না করলে আপনের জন্যে ভালো। ঝামেলা করলেও জিনিস একই হবে। মাঝখান থেকে আপনার ক্ষতি। সুনামগঞ্জে খবর যাবে হাওর থেকে ফেরার সময় নৌকাডুবি হয়ে ফিসারিজ অফিসার এবং তার স্ত্রী মারা গেছে। হাওরে নৌকাডুবি কোনো ব্যাপারই না।
রকিবউদ্দিন কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আপনি এইসব কী বলছেন? কী বলছেন?
বশির মোল্লা বললেন আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। আমি, আপনি আর ম্যাডাম এই তিনজন ছাড়া ঘটনা আর কেউ জানবে না। কাতল মাছের নামে ওয়াদা করতেছি। ভাটি অঞ্চলের সবাই জানে বশির মোল্লা যখন মাছের নামে ওয়াদা করে তখন ওয়াদা রাখে।
নৌকা থেকে রকিবউদ্দিনের স্ত্রী হাসি মুখে চেঁচিয়ে বলল, এই তোমরা দুজন গুটুর গুটুর করে কী আলাপ করছ? দুজন একটু ডান দিকে আস। আমি ছবি তুলে রাখি। সুন্দর কম্পোজিশন। এখান থেকে ব্যাকগ্রাউন্ডে হাওরটা এত সুন্দর লাগছে!
বশির মোল্লা বললেন, স্যার, ম্যাডাম আমাদের ডানে সরতে বলেছেন। ছবি তুলতে তুলতে মন ঠিক করেন আমার প্রস্তাবে রাজি না অরাজি।
রকিবউদ্দিন জায়গা থেকে নড়তেও পারছেন না, জবাবও দিতে পারছে না। আতঙ্কিত এবং বিস্মিত চোখে বশির মোল্লার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বশির মোল্লা লক্ষ করল রকিব উদ্দিনের মুখ থেকে অতি দ্রুত বিস্ময় দূর হচ্ছে। আতঙ্ক বাড়ছে। আতঙ্কিত হলে একেক মানুষের চোখ একেক রকম হয়ে যায়। কারো চোখ অক্ষ্মিকোঠারে ঢুকে যায়। আবার কারো চোখে অক্ষ্মিকোঠর থেকে বের হয়ে আসে। রকিবউদ্দিনের চোখ বের হয়ে আসছে। বশির মোল্লা মুগ্ধ হয়ে এই দৃশ্য দেখছেন। বশির মোল্লা তার জীবনে এত আতঙ্কিত হতে কাউকে দেখেন নি। এখনো কোনো কারণে মন টন খারাপ থাকলে রকিবউদ্দিনের আতঙ্কিত মুখের ছবিটা মনে করার চেষ্টা করেন। তার বড় ভালো লাগে।
আজ বশির মোল্লার মন ভালো। প্রধান কারণ ঠাণ্ডা লেগে সর্দির মতো হয়েছে। সর্দিতে নাক বন্ধ। কোনো কিছুরই ঘ্রাণ পাচ্ছেন না। কাজেই আজ মাছ খেতে পারবেন। গন্ধ কোনো সমস্যা হবে না। বাইন মাছ এনে রান্না করতে বলেছেন। লঞ্চের বাবুর্চি ঝোল ঝোল করে বাইন মাছ খুব ভালো রান্না করে। বাইন মাছের সন্ধানে লোক গেছে।