আমি লক্ষ করি নি।
সার্কাস দেখতে আরেকদিন যখন আসবেন তখন লক্ষ করবেন।
অবশ্যই লক্ষ করব।
আমরা তিন বোন চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি কেন জানতে চান?
হ্যাঁ, জানতে চাই।
আমরা তিন বোন তখন আল্লাহর কাছে একটা প্রার্থনা করি। আমরা আল্লাহকে বলি–আল্লাহপাক, তুমি আমাদের বাবা-মাকে ফিরিয়ে এনে দাও। আবার যেন আমরা এক সঙ্গে হতে পারি।
তোমার বাবা-মা কোথায় গেছেন?
জানি না কোথায় গেছেন। প্রথমে মা চলে গিয়েছিলেন। মাকে ফিরিয়ে আনতে বাবা গিয়েছেন।
তোমরা রোজ দড়িতে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা কর যেন তারা ফিরে আসেন?
রোজ করি না। যেদিন সার্কাসের খেলা থাকে সেদিন করি। আমরা তিন বোন ঠিক করে রেখেছি যত দিন আমরা সার্কাসে খেলা দেখাব ততদিনই দড়ির উপর দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করব।
তোমাদের ধারণা প্রার্থনায় ফল হবে? হারানো বাবা-মা ফিরে আসবেন?
পয়সা গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বলল, অবশ্যই তারা ফিরে আসবে। আমরা তিন বোন তো আল্লাহর কাছে আর কোনো কিছুই চাই না। একটা জিনিসই চাই।
পয়সা।
জি।
তোমার গল্পটা যে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী তা-কি তুমি জানো? আমি মোটামুটি কঠিন মানুষ কিন্তু আমার চোখে পানি এসে গেছে। আমি নিশ্চিত তুমি তোমার বাবা-মাকে ফেরত পাবে।
পয়সা চোখ মুছল। এখন তার চোখ ভর্তি পানি, তবে চোখের পানি নিয়ে এখন সে আর ব্ৰিত না। সে স্কার্ফ দিয়ে চোখ মুছল। নি পোর্টার বলল–তোমাদের মিলন দেখার খুব ইচ্ছা হচ্ছে। সেই দৃশ্য কতই না আনন্দময় হবে!
পয়সা বলল, আমি এখন যাই।
নি পোর্টার বলল, অবশ্যই তুমি এখন যাবে না। আমরা ব্রেকফাস্ট করব, তারপর আমি তোমাকে নিয়ে স্পিডবোটে করে ঘুরতে বের হবো। তোমাকে নিয়ে আমার বিশেষ পরিকল্পনা আছে। আজ তোমার অনেক ছবি তোলা হবে। সেই ছবি আমি দেশের বাড়িতে পাঠাব। আচ্ছা মেয়ে শোন, তুমি দেখি কেঁদেই যাচ্ছ। এত কাঁদছ কেন?
পয়সা বলল, যে যত হাসে তাকে কাঁদতে হয়। আমি খুব বেশি হাসি, এই। জন্যেই আমাকে খুব কাঁদতে হয়। রামসন্যা বলেছেন—
যত হাসি তত কান্না
বলে গেছেন রামসন্যা।
রামসন্যা কে?
আমি জানি না উনি কে। তবে উনার কথা খুব সত্যি হয়।
কথাটা আবার বলো তো, আমি আমার নোটবুকে লিখে রাখি।
পয়সা গম্ভীর গলায় বলল–
যত হাসি তত কান্না
বলে গেছেন রামসন্যা।
হারুন সরকার চোখে স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে না। অথচ ঘরে আলো আছে। তার চোখে ছানিও পড়ে নি। তাহলে এরকম হচ্ছে কেন? মৃত্যু কি এসে গেছে? খাটের নিচে আজরাঈল বসে আছে ঘাপটি মেরে? খাটের নিচ থেকে আজরাঈল তার ঠাণ্ডা হাত বের করে হারুন সরকারকে ছুঁয়ে দেবে। তখন শীতে শরীর কাঁপতে থাকবে। মৃত্যুর আগে আগে মানুষ হঠাৎ শীতে কাতর হয়। হারুন সরকারের এখনো শীত লাগছে না, তবে শীত লাগার সময় মনে হয় হয়ে গেছে।
হারুন সরকারের সামনে যে দাড়িয়ে আছে সে যে তিন বোনের একজন তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কোন জন? তিনটি বোনের চেহারাই এক রকম। এই জন্যেই কি হারুন সরকার ধরতে পারছে না?
তুমি কে? নাম কী?
জামদানী।
হারুন সরকার বলল, তুমি ভালো আছ?
জামদানী ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আপনার এ কী অবস্থা!
হারুন সরকার বলল, হাসপাতাল থেকে চলে আসা ঠিক হয় নাই। ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমি সারা জীবন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জামদানী তুমি বসো।
জামদানী বিস্মিত হয়ে বলল, আমি তো বসে আছি। আপনার সামনের চেয়ারটায় বসে আছি। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না?
হারুন সরকার হতাশ গলায় বলল, সব কিছু ঝাপসা লাগছে। মনে হয় যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। অনেক কষ্ট করে সার্কাসটা করেছিলাম। সার্কাস ফেলে চলে যাব–এই জন্যেই খারাপ লাগছে। তৈয়বকে পাঠাও। তৈয়বের সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
সময় কতটা পার হয়েছে হারুন সরকার বলতে পারছে না। তৈয়ব সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে অন্যদিনের চেয়েও নয়া লাগছে। হারুন সরকার বলল, কেমন আছ তৈয়ব?
তৈয়ব বলল, আপনি কথা বলবেন না। আপনাকে সদর হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
মরতে হলে এইখানেই মরব। হাসপাতালে মরব না। শোন তৈয়ব, আমি এখনো হাতির বাচ্চাটাকে দেখি নাই। হাতির বাচ্চাটাকে এখানে নিয়ে আস।
তৈয়ব চলে গেছে। হারুন সরকার হাতির বাচ্চাটার জন্যে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে। আসমানী এবং জামদানী–এই দুই বোন এখন তার সামনে। এদের দুজনকে মোটামুটি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। তৃতীয়জন গেল কোথায়? হারুন গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, তোমরা কেমন আছ?
আসমানী এবং জামদানী কেউ কিছু বলল না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। হারুন সরকার বিড়বিড় করে বলল, তোমাদের ছোটবেলায় দড়ির খেলা শিখাবার জন্যে খুব কষ্ট দিয়েছি, তোমরা কিছু মনে রেখ না।
আসমানী বলল, আপনি কথা বলবেন না। আপনি চুপ করে থাকুন।
খুব কষ্ট করে সার্কাসটা গুছিয়েছিলাম। যদি সম্ভব হয় এটাকে টিকিয়ে রাখবে।
হারুন সরকার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনল। সে আগ্রহ নিয়ে বলল, কে কাঁদে?
দুই বোনের কেউ জবাব দিল না। হারুন সরকারের মনে হলো দুই বোনই কাঁদছে। সে কে? সে কেউ না। তার জন্যেও মানুষ কাঁদছে। এরচে আনন্দের। আর কী হতে পারে?
বশির মোল্লা মাছ খেতে পারেন না
বশির মোল্লা মাছ খেতে পারেন না। মাছের গন্ধে তার বমি আসে। শরীর গুলাতে থাকে। মাঝে মধ্যে জোর করে খেয়ে দেখেছেন খাওয়ার পর পর সারা শরীরে চাকা চাকা কী যেন হয়। চুলকানি হয়। সিলেটে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। ডাক্তার বলল, মাছ খাবেন না। মাছে আপনার এলার্জি। বশির মোল্লা বললেন, শরীরে চাকা চাকা হওয়া কি এলার্জি? তাহলে তো আমার মেয়ে-মানুষেও এলার্জি আছে। নতুন কোনো মেয়ে-মানুষের কাছে গেলেও আমার শরীরে চাকা চাকা কী যেন হয়। চুলকানি হয়। সেই চুলকানি কমতে এক-দুই দিন লাগে। শরীরে তিসির তেল মালিশ করতে হয়।