পয়সা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি।
নি পোর্টার তৎক্ষণাৎ তাঁবুর বাইরে এসে চিন্তিত গলায় বলল, তুমি? Is anything wrong? কোনো বিপদ হয়েছে?
পয়সা বলল, না।
এসো, ভেতরে এসো।
পয়সা তাঁবুর ভেতর ঢুকল। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে তার খুবই অস্বস্তি লাগছিল। সবাই কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছিল। তাঁবুর ভেতর ঢুকে সেই অস্বস্তি পুরোপুরি কেটে গেল। সার্কাসের মেয়ে এমনিতেই তাঁবুর ভেতর স্বস্তি বোধ করে। তাদের জীবনই কাটে তাঁবুতে। তার উপর এই তাবুটা নি পোর্টারের। অন্য কারোর না।
মিস কয়েন, ভোরবেলা তোমাকে দেখে বিস্ময় পেয়েছি।
পয়সা বলল, আমি ভোরবেলা হাঁটতে বের হয়েছিলাম। তখন ভাবলাম আপনার তাঁবুর পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন দেখে যাই আপনি কী করছেন।
নি পোর্টার বলল, তোমার অন্য দুবোন কোথায়? ওরা তোমার সঙ্গে হাঁটতে বের হয় নি?
না।
মিস কয়েন, তুমি যে এই ভোরবেলা হাঁটতে বের হয়েছ এটা ঠিক না। তোমাদের দেশের মেয়েরা এত ভোরে একা একা হাঁটতে বের হয় না।
আমি আমাদের দেশের অন্য মেয়েদের মতো না। আমি আলাদা।
তুমি আলাদা কেন?
আমি সার্কাসের মেয়ে এই জন্যে আমি আলাদা।
নি পোর্টার বলল, আচ্ছা তাহলে আমার ত্রুটি হয়েছে। তুমি সকালে মর্নিংওয়াক করতে বের হয়েছিলে। হঠাৎ মনে হলো–বিদেশী সাহেবের সঙ্গে কফি খাব। তখন চলে এসেছ।
হ্যাঁ তাই।
কফি খাবার জন্যে আটটা বাজা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কফি আসবে আটটায়। এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারবে?
পয়সা জবাব দিল না। সে তার মাথায় প্যাচানো নীল রঙের স্কার্ফটা খুলে ফেলল। আঁকি দিয়ে মাথার চুল ঠিক করল। তার খুবই অদ্ভুত লাগছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে এই তাবুটাই তার ঘরবাড়ি।
মিস কয়েন, আমার মনে হয় তুমি আমাকে কিছু বলতে এসেছ। যা বলতে এসেছ বলে ফেল।
পয়সা বলল, আপনার চোখের যে নীল রঙ সেটা সব সময় এক রকম থাকে। কখনো বাড়ে কখনো কমে। এটা কি আপনি জানেন?
তুমি কি এই কথাটাই বলতে এসেছ?
হ্যাঁ।
চোখের নীল রঙ কি তোমার পছন্দ?
না।
তোমার কী রঙ পছন্দ?
কালো।
আচ্ছা বেশ, আমি চোখ কালো করে ফেলব।
পয়সা বিস্মিত হয়ে বলল, কীভাবে?
কালো রঙের কনট্যাক্ট লেন্স পরলেই চোখ কালো হয়ে যাবে। আবার ধর তুমি যদি নীল রঙের কোনো কনট্যাক্ট লেন্স পর তাহলে তোমার চোখ…
পয়সা আগ্রহের সঙ্গে বলল, দিন আমার চোখ নীল করে। দেখি নীল চোখে আমাকে কেমন লাগে।
আমার সঙ্গে কনট্যাক্ট লেন্স নেই। লেন্স লাগানোর জন্যে ঢাকায় যেতে হবে। আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করব।
কবে ব্যবস্থা করবেন?
যত দ্রুত পারি ব্যবস্থা করব। শোন মিস কয়েন, একটু আগে তুমি বলছিলে নীল রঙ তোমার পছন্দ না। এখন আবার বলছ তোমার নিজের চোখ নীল করতে চাও। ব্যাপারটা কী বলো তো?
পয়সা বলল, একটু আগে আমি মিথ্যা কথা বলছিলাম। নীল রঙ আমার পছন্দ।
নি পোর্টার বলল, মিথ্যা কথা দিয়ে দিন শুরু করলে সারা দিন মিথ্যা কথা বলতে হয়, এটা কি তুমি জানো?
না।
এটা হলো আমার দাদিমার কথা। আমার ধারণা কথাটা ঠিক। আমি অনেকবার লক্ষ করেছি যেদিনই আমি সকালে মিথ্যা কথা বলেছি, সেদিন ঘুমুতে যাবার আগ পর্যন্ত আমাকে মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে। এসো মিস কয়েন, একটা চুক্তি করি। তুমি আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবে না। যা জিজ্ঞেস করি তার সত্যি জবাব দেবে।
আমি সব সময় সত্যি কথা বলি, শুধু আপনার সঙ্গেই মিথ্যা বলি।
কেন?
আমি জানি না কেন?
আমার ধারণা তুমি জানো।
না, আমি জানি না।
এই তো আবার মিথ্যা কথা বলছ।
পয়সা হেসে ফেলল। কোনো কারণ নেই অথচ তার কী যে আনন্দ লাগছে! একটা বড় সমস্যা হয়েছে তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সাহেবের সামনে কেঁদে ফেলা মোটেই ঠিক হবে না। ব্যাটা একগাদা প্রশ্ন করবে। সত্য কথা বলা হচ্ছে না-কি মিথ্যা বলা হচ্ছে এই নিয়ে ঝামেলা করবে। পয়সার যে কাজটা করতে হবে তা হচ্ছে ব্যাটা যাতে কিছু বুঝতে না পারে সেইভাবে মাথার স্কার্ফটা হাতে নিতে হবে। সেই স্কার্ফ মাথায় জড়াবার সময় কৌশল করে এক ফাঁকে চোখ মুছে ফেলতে হবে। সেটা কি সম্ভব হবে।
পয়সা, তুমি কাঁদছ কেন?
কাঁদছি না।
অবশ্যই কাঁদছ। তোমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কেন কাঁদছ?
জানি না কেন কাঁদছি।
অবশ্যই তুমি জানো।
জানলে জানি। আপনার কী?
আমাকে বলবে না?
না, আমি বলব না।
আটটা বেজে গেছে। বাবুর্চি কফি নিয়ে এসেছে। সে এমনভাবে পয়সার দিকে তাকাচ্ছে যেন চোখের সামনে ভূত দেখছে। সার্কাসের একটা মেয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে বসে আছে। ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। এর মানে কী?
নি পোর্টার বলল, রহমত উল্লাহ, তুমি আরেক কাপ কফি নিয়ে এসো। মিস কয়েন আমার সঙ্গে নাশতা করবে সেই ব্যবস্থা কর। আজ আমার সাইটে যেতে দেরি হবে এই খবরটা দিয়ে এসো। আর শোন, তুমি এক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছ কেন? কারো দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সে খুব অস্বস্তি বোধ করে। এবং এটা অদ্রতা।
রহমত উল্লাহ পয়সার মুখ থেকে চোখ না নামিয়েই বলল, জি স্যার।
পয়সা নিজেকে সামলে নিয়েছে। সে এখন সহজ এবং স্বাভাবিক। গুট গুট করে গল্প করছে। হাসছে। যেন এই তাবুই তার ঘরবাড়ি। গল্প শেষ করেই সে যেন তাবু গুছাতে শুরু করবে। ময়লা কাপড় ধোয়ার জন্যে আলাদা করবে।
পয়সা বলল, আচ্ছা আপনি কি লক্ষ করেছেন আমরা তিন বোন যখন দড়ির খেলা দেখাই তখন একটা সময় তিন বোন দড়ির মাঝামাঝি চলে আসি এবং কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন আমাদের তিন বোনেরই চোখ বন্ধ থাকে।