স্পিড বোট নিয়ে ঘোরার সময়ও মজা কম হলো না। এক সময় সাহেব বলল, তোমরা কেউ স্পিড বোট চালাবে? হাল ধরে থাকলেই হবে। আর কিছু করতে হবে না।
পয়সা বলল, আমি চালাব।
আসমানী বলল, না না, তুই উল্টে ফেলবি।
উল্টে ফেললে ফেলব কিন্তু আমি চালাবই।
পয়সা কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই স্পিড বোট চালাল। তখন জামদানী বলল, আমিও চালাব।
আসমানীও বাদ রইল না।
পয়সার শরীর ঝনঝন করছে। কিছুতেই সে বুঝে উঠতে পারছে না তার এত আনন্দ হচ্ছে কেন? খুব বেশি আনন্দ হলে তার শরীর টলমল করতে থাকে। তখন খুব সমস্যা হয়। দড়ির উপর ঠিকঠাক পা পড়ে না। ব্যালেন্সে খুব অসুবিধা হয়। আজ অবশ্যই অসুবিধা হবে। এবং আরেকটা ব্যাপারও হবে–রাতে এক ফোটা ঘুম হবে না। পয়সার এই ব্যাপারটা মাঝে মাঝেই হয়। সারারাত এক ফোটা ঘুম আসে না।
হারুন সরকারের মনে হচ্ছে তার শরীর পুরোপুরি সেরে গেছে। দুর্বল ভাবটা আছে, বুকের ধুকধুকানিও আছে। তার পরেও শরীর যে পুরোপুরি সেরেছে এই বিষয়ে সে নিশ্চিত। কারণ সিগারেটে টান দিতে ভালো লাগছে। জিনের গ্লাসে চুমুক দিতেও ভালো লাগছে। বমি আসছে না। শরীর সেরেছে কী সারে নি তার আসল পরীক্ষা সিগারেটে। শরীর খারাপ থাকলে সিগারেটে টান দেয়া যায় না। সে তো ভালোই টানছে। হারুন সরকার তেঁতুল মিশানো জিনের গ্লাসে লম্বা টান দিয়ে গাঢ় স্বরে ডাকল, তৈয়ব!
তৈয়ব বলল, জি।
কাছে আছ তো?
জি, কাছে আছি।
শো শুরু করে দিয়ে আবার চলে আসবে।
জি চলে আসব। কিন্তু আপনে একটু ধীরে খান। আপনার শরীর ঠিক হয়। নাই।
শরীর ঠিক আছে। আমার শরীর আমি বুঝব না, তুমি বুঝবে? শরীর নিয়া কোনো কথা বলব না। টিকিট বিক্রির অবস্থা কী?
আজও সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।
হারুন সরকার তৃপ্তি নিয়ে বলল, হাতির বাচ্চাটার জন্মের পর থেকে আমাদের ভাগ্য ফিরে গেছে।
হতে পারে।
হতে পারে টারে কিছু না। ঘটনা এটাই। হাতির বাচ্চারে একটা রূপার ঘণ্টা বানায়ে দিবে। ঘণ্টা গলায় ঝুলবে।
জি আচ্ছা।
কালকের মধ্যে ঘণ্টা বানাতে হবে। ঘণ্টা আমি নিজের হাতে পরায়ে দিব।
জি আচ্ছা।
আমি হাতির বাচ্চাটা এখনো দেখি নাই। এটা একটা আফসোস। কাল দেখবেন।
অবশ্যই কাল দেখব। নিজের হাতে গলায় ঘন্টা পরায়ে দেব।
এখন যাই। শো টাইম হয়ে গেছে।
আর দশটা মিনিট বসো। গ্লাসটা শেষ করি। নতুন এক গ্লাস বানায়ে হাতে ধরায়ে দিয়ে যাও।
তৈয়ব দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আবার বসল। হারুন সরকার বলল–চারদিন পার করে দিলাম এখনো কোনো ভেজাল হয় নাই। বিরাট আশ্চর্য ঘটনা। ঠিক না?
ঠিক। তবে ছোট্ট ভেজাল বোধহয় হবে।
কী ভেজাল?
বশির মোল্লা বলে এক লোক মনে হয় ঝামেলা করবে। সহজ ঝামেলা না। জটিল ঝামেলা। সে সার্কাস কিনে নিতে চায়।
কোনখানের ফাজিল?
ভাটি অঞ্চলের। সে আমাকে দালাল ধরেছে। দালালি বাবদ দশ হাজার টাকাও দিয়েছে।
বলো কী?
আমি খোঁজ নিয়েছি–লোক ভয়ঙ্কর।
সার্কাস কিনতে চায় কেন?
মেয়ে তিনটার জন্যে কিনতে চায়। সার্কাসের যে মালিক সে মেয়ে তিনটারও মালিক, আর কিছু না।
হারুন সরকার চিন্তিত গলায় বলল, আমার তো নেশা কেটে যাওয়া ধরেছে। এটা তুমি কী বললা?
তৈয়ব কিছু বলল না। হারুন বলল, সমস্যার সমাধান কী?
তৈয়ব চুপ করেই রইল। হারুন সরকার বলল, ঐ লোকের নাম কী? বশির মোল্লা।
তাকে বলো যে সার্কাস আমি বেচে দিব। কিন্তু দাম এক কোটি টাকা। তখন বাপ বাপ করে দৌড় দিয়ে পালায়ে যাবে।
তৈয়ব বলল, পালাবে না। সে এই টাকা খরচ করবে। আমি নিশ্চিত।
হারুন সরকার চিন্তিত গলায় বলল, এখন করা যায় কী?
ঘণ্টা পড়ে গেছে। শো শুরু হবে। তৈয়ব আলী ওঠে দাঁড়াল।
রাত দুটা বাজে। পয়সা পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে আছে। স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙেছে। এখন আর ঘুম আসছে না। স্বপ্নটা তেমন অদ্ভুত না। তার জন্যে সাধারণ স্বপ্ন। সে প্রায়ই দেখে। তবে আজকের স্বপ্নটা একটু অন্যরকম। সে দেখেছে দড়ির খেলা হচ্ছে, হঠাৎ ব্যালেন্স হারিয়ে সে দড়ি থেকে পড়ে গেল। শাঁ শাঁ শব্দ হচ্ছে, সে নিচে নামছে নিচে নামছে। চারদিক থেকে চিৎকার–বাঁচাও বাঁচাও। এই পর্যন্ত স্বাভাবিক স্বপ্ন। পয়সা নিয়মিতই এই স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্নের পরের অংশটা অস্বাভাবিক। স্বপ্নের মধ্যে সে শুনল ভট ভট শব্দ হচ্ছে। নিচে তাকিয়ে দেখে বিশাল সমুদ্র। সে পড়ে যাচ্ছে সমুদ্রে। ভট ভট শব্দটা স্পিড বোটের। তাকে বাঁচানোর জন্যে নি পোর্টার স্পিড বোট নিয়ে ছুটে আসছে।
পয়সার স্বপ্ন এই পর্যন্ত। সে বাঁচল না-কি সমুদ্রে তলিয়ে গেল সেটা আর দেখা হলো না।
পয়সা।
হুঁ।
কী হয়েছে?
পয়সা জবাব দিল না। আসমানী বলল, তুই কাঁদছিস কেন?
পয়সা গালে হাত দিয়ে দেখল গাল ভেজা। তার চোখ দিয়ে যে পানি পড়ছে এটা সে নিজেও জানে না। একটা ব্যাপার শুধু জানে তার খুব একলা লাগছে। যেন সে এখন আর তিন বোনের একজন না। সে আলাদা।
আপা।
কী?
কাল সকালে আমি কিন্তু ঐ বিদেশী সাহেবের কাছে বেড়াতে যাব।
ঠিক আছে তোকে নিয়ে যাব।
তোমরা যাবে না আপা, আমি একা যাব।
আসমানী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা, তোর যদি ভালো লাগে তুই একাই যাবি।
তাঁবুর বাইরে পায়ের আওয়াজ
তাঁবুর বাইরে পায়ের আওয়াজ। কে আসবে এত ভোরে? ভিক্ষুকশ্রেণীর ছেলেপুলে আগে এরকম আসত। তাঁবুর পাশে ঘুরঘুর করত। ফেলে দেয়া বিয়ারের ক্যান, কোকের ক্যান নিয়ে যেত। এমন কি সিগারেটের খালি প্যাকেটের প্রতিও তাদের আগ্রহ। ইদানীং সিকিউরিটি টাইট হয়েছে। বিদেশীদের তাঁবুর পাশে কাউকে আসতে দেয়া হয় না। তাহলে এত ভোরে কে আসবে? রহমত উল্লাহ বাবুর্চি মগ ভরতি গরম কফি নিয়ে এসে ঘুম ভাঙায়। সেই সময়ও হয় নি। ঘড়িতে বাজছে সাতটা। বাবুর্চির আসার সময় ঠিক আটটায়। নি পোর্টার বলল, Who is there? কে?