আচ্ছা করতেছি। আপনি শান্ত হন।
হারুন সরকারের রাগ সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল। এতক্ষণ তিনি যে রাগারাগি করছিলেন তার জন্যে খানিকটা লজ্জাও লাগল। হুট করে এতটা রাগ করা ঠিক হয় নি। তৈয়ব ছেলে ভালো।
তৈয়ব!
জি।
আমারে বের করার ব্যবস্থা কর।
জি করতেছি।
আজ রাতটা এখানে থাকলে আমি মারা যাব। অবশ্য এখানে না থাকলেও মারা যাব। তখন মরব নিজের বিছানায়।
আপনার শরীর কিন্তু বেশি খারাপ।
শরীর খারাপ হোক বা ভালো হোক, তুমি তেঁতুলের জোগাড় দেখ।
কী বললেন?
প্রশ্ন করবা না। যা বলব মাথা হেট করে শুনবা এবং সেই মতে কাজ করবা। খাম্বার মতো দাঁড়ায়ে আছ কেন? আমার রিলিজের কী ব্যবস্থা করলা?
করতেছি।
হারুন সরকার ক্ষুব্ধ গলায় বলল, আমি সকাল থেকে ছটফট করতেছি, তুমি আসলা সন্ধ্যা পার করে। আমি যে একটা মানুষ এই বোধটা তো তোমাদের মধ্যে নাই। কেউ তো আমারে দেখতেও আসল না। আর কেউ আসুক না আসুক জামদানীর তো আসা উচিত ছিল। এই মেয়েটাকে আমি অত্যাধিক স্নেহ করি।
আমি সবাইকে আসতে নিষেধ করেছি।
কেন?
আসলেই আপনি কথা বলবেন। আপনার বিশ্রাম হবে না।
আমার দিকে তোমার দেখি বড়ই দরদ। শোন তৈয়ব, মায়ের চেয়ে যদি অন্য কারোর প্রতি বেশি দরদ হয় তারে বলে ভান। ভান কি জানো?
না।
ভান হলো শয়তান। তুমি অবশ্যই শয়তান।
জি আচ্ছা। দেখি আপনের রিলিজের ব্যবস্থা করি।
তেঁতুল লাগবে। আজ কিন্তু তেঁতুল ছাড়া হবে না। আরেকটা কথা–জামদানীরে নিষেধ করবা সে যেন আগামী সাতদিন আমার সামনে না আসে। আমি তার উপর বেজার হয়েছি। তাদের তিন বোনুরেই এই কথা বলবা। তাদের তিনজনের উপরই আমি বেজার হয়েছি। এদেরকে আমি অত্যাধিক স্নেহ করতাম। এখন অত্যাধিক ঘৃণা করি। আমার সবই বেশি বেশি। আমার স্নেহ যেমন বেশি, ঘৃণাও বেশি। আমার মধ্যে মাঝামাঝি বলে কিছু নাই। অমাবস্যাপূর্ণিমায় জন্ম নিলে এই জিনিস হয়। তাদের মাঝামাঝি কিছু থাকে না। আমার জন্ম পূর্ণিমার রাতে। তারিখটা এখন মনে পড়তেছে না। পেটে মাল পড়লে মনে পড়বে। তখন তোমারে বলব।
জি আচ্ছা।
তৈয়বের সঙ্গে কথা বলে হারুন সরকার হাপিয়ে গিয়েছে। বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কিন্তু তার শরীরটা এখন আগের চেয়ে ভালো লাগছে। মাথা ঘুরানো বন্ধ হয়েছে। তলপেট থেকে ধাক্কার মতো কী যেন উপরের দিকে আসত। সেটাও বন্ধ। শুধু বুক ধুকপুক করছে। শব্দ করে করছে। মনে হচ্ছে কেউ তার জামার নিচে বসে ডুগডুগি তবলা বাজাচ্ছে। যে বাজাচ্ছে সে প্লেয়ার ভালো। বিশ্রাম নেয়ার জন্যে এক মুহূর্তের জন্যও থামছে না। বাজিয়েই যাচ্ছে। তেরে কেটে তাক তাক। তেরে কেটে তাক তাক।
আসমানীরা তিন বোন স্পিড বোটে বসে আছে। নি পোর্টার স্পিড বোট চালাচ্ছে। তিন বোনই খুব মজা পাচ্ছে। বাঁক নেবার সময় স্পিড বোট কাত হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে এই বুঝি উল্টে পড়ল পানিতে। মজাটা তখন খুব বাড়ছে। আসমানী এবং জামদানী প্রথমে বিদেশী সাহেবের কাছে কিছুতেই আসতে রাজি হয় নি। কিন্তু পয়সা যাবেই। তার একটাই কথা–তাকে চা খাবার দাওয়াত করা হয়েছে। সে বলেছে যাবে। এখন আর কিছুতেই না বলা সম্ভব না। এটা সে করতে পারবে না।
জামদানী বলল, করতে পারবে না কেন?
পয়সা কঠিন মুখ করে বলল, কারণ আমি বলেছি যাব।
আসমানী বলল এটা তো কোনো কঠিন প্রতিজ্ঞা না, যে যাব বললে যেতেই হবে।
পয়সা বলল, আমার জন্যে এটা কঠিন প্রতিজ্ঞা।
আসমানী বলল, তোর জন্যে কঠিন প্রতিজ্ঞা হবে কেন? তুই কি ঐ লালমুখা বান্দরের প্রেমে পড়েছিস?
পয়সা বলল, হ্যাঁ আমি প্রেমে পড়েছি। আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তার চাদমুখ না দেখতে পেলে আমি মরে যাব।
তামাশা করছিস কেন?
আমি তামাশা করছি না। তোমরা তামাশা করছ। আমাকে আটকে রাখছ। আমি দশ মিনিটের জন্যে যাব। এক কাপ চা খেয়ে চলে আসব।
ঠিক আছে তাহলে আমরাও যাব।
পয়সা বলল, বেড়াতে যাবার জন্যে যদি যেতে চাও তাহলে অবশ্যই যাবে। কিন্তু আমাকে পাহারা দেবার জন্যে যেতে পারবে না।
আসমানী বলল, তুই কি পাহারার উর্ধ্বে?
পয়সা বলল, হ্যাঁ।
জামদানী বলল, তুই কিন্তু তোর জন্যে বিরাট বিপদ ডেকে আনছিস। খাল কেটে বিদেশী কুমীর আনছিস।
পয়সা ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, ভালো করছি।
আসমানী এবং জামদানী মেজাজ খারাপ করে বোনের সঙ্গে গেল। যাবার পথে দুজনের কেউই একটা কথাও বলল না।
নি পোর্টারের তাঁবুর ভেতর ঢোকার দশ মিনিটের মাথায় তিনজনেরই মেজাজ ভালো হয়ে গেল। কারণ নি পোর্টার তাদের জন্যে ভালো চমকের ব্যবস্থা রেখেছিল। সে তার ভিডিও ক্যামেরায় দড়ির উপর তিন বোনের ছোটাছুটির পুরোটাই ভিডিও করে রেখেছিল। লং শট, ক্লোজআপ সবই আছে। দর্শকদের রিএকশান আছে। পয়সা যে মাঝে মধ্যেই পড়ে যাবার ভঙ্গি করছে। আবার দড়ি থেকে লাফিয়ে উঠে নিজেকে ঠিক করছে তাও আছে।
ভিডিও দেখে তিনবোনই অবাক। তাদের নিজেদের খেলাটা যে এত সুন্দর এত মজার তা তারা কল্পনাও করে নি। পয়সা বলল, আমি আবার দেখব। নি পোর্টার হাসি মুখে বলল, অবশ্যই। পুরোটা আবার দেখা হলো। দ্বিতীয়বার দেখার সময় তিন বোনের আরো মজা লাগল। পয়সার আরো একবার দেখতে ইচ্ছা করছে কিন্তু লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারছে না।
তিন বোনের জন্য গিফট র্যাপে মোড়া তিন প্যাকেট চকলেট ছিল। আর তিনটা সেন্টের শিশি। শিশির রঙ গাঢ় নীল। আর শিশিটা এমন অদ্ভুত সুন্দর। দেখে মনে হয় নীল রঙের তিন মেয়ে কোমর বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পয়সার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল–তারা তিন বোন পুরস্কার হিসেবে সোনা-রুপার মেডেল পেয়েছে, টাকা পেয়েছে; কিন্তু এত সুন্দর উপহার তাদেরকে কেউ দেয় নি।