সার্কাসের দল দিয়ে আপনি কী করবেন?
কী করব সেটা আমার বিবেচনা। আমার নিজের একটা যাত্রার দল আছে। নাম সুন্দরী অপেরা। তারা নিজের মনে সারা দেশে পাট গায়। কী টাকা পায়, কী না পায় এটা নিয়ে আমি ভাবি না। যাত্রা দল আমি যেভাবে কিনেছি সার্কাসও সেইভাবে কিনব। যাত্রার দল কেন কিনেছিলাম বলব?
বলুন।
সুন্দরী অপেরার একটা পালা দেখে মন উদাস হয়েছিল। যে মেয়েটা নায়িকার বোন করেছিল সে ছিল সাক্ষাৎ বিউটি। তার নাম হেনা। মাঝে মাঝে আমার মন যদি উদাস হয় তখন খবর দিয়া যাত্রার দল নিজের কাছে নিয়া আসি। হেনারে বলি, পাট গাইয়া শোনাও। সে পাট গায়।
সার্কাস কিনতে চাচ্ছেন কেন? সার্কাসের কাউকে মনে ধরেছে?
দড়ির খেলা যে দেখায়েছে এদের প্রত্যেকটারে মনে ধরেছে। বিশেষ করে ছোটটারে। আচ্ছা ছোট মেয়েটার নাম নাকি পয়সা, এটা কি সত্য?
হ্যাঁ সত্য।
পয়সা যার নাম সে তো থাকবে আমার সাথে। টাকা পয়সা বশির মোল্লার কাছে না থাকলে কার কাছে থাকবে বলেন?
স্যার, আজ আমি উঠি।
উঠতে চাইলে উঠেন। আপনের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি এই জন্যে সামান্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে।
বশির মোল্লা বালিশের নিচে থেকে একশ টাকার একটা বান্ডিল বের করল। এমনভাবে বের করল যেন পিস্তলটা দেখা যায়। তৈয়ব শুকনা গলায় বলল, আমাকে কিছু দিতে হবে না।
বশির মোল্লা বিরক্ত গলায় বলল, আমারে না কথাটা বলবেন না। না শুনতে আমার ভালো লাগে না। এইখানে দশ হাজার টাকা আছে। টাকাটা রাখেন। সন্ধ্যাকালে আবার আপনার সাথে দেখা হবে।
আবার দেখা হবে কেন?
পয়সা মেয়েটারে মেডেল দিব ডিক্লেয়ার দিয়েছি। মেডেল দিব না? স্বর্ণকারের দোকানে লোক চলে গেছে। দুই ভরি ওজনের মেডেল। মেডেলের সাথে টাকার পরিমাণ আগে বলেছিলাম এক হাজার, এখন এটারে বাড়ায়ে করেছি দশ হাজার। এক হাজার টাকা দিলে বশির মোল্লার মান থাকে না। আপনের নামটা ভুলে গেছি। আপনার কী যেন নাম?
তৈয়ব।
পাখির ক্যাচক্যাচানি শুনতেছেন?
কীসের ক্যাচক্যাচানি?
পাখির।
জি শুনতেছি।
ক্যাচক্যাচ শব্দটা এক্কেবারে মাথার ভিতরে ঢুকে। এরা এমন ত্যক্ত করে। ঐ, পাখির ক্যাচক্যাচানি থামাও।
বশির মোল্লার কথা শেষ হবার আগেই লঞ্চের ছাদ থেকে দোনলা বন্দুকের আওয়াজ হলো। তৈয়ব বুঝতে পারছে বন্দুকের শব্দ পাখিদের শুনানোর জন্যে না। তাকে শুনানোর জন্যে।
হারুন সরকার হাসপাতালের বিছানায় পা গুটিয়ে বসে আছে। তার মাথা ঘুরছে, শরীর এলোমেলো লাগছে। মনে হচ্ছে যে-কোনো মুহূর্তে সে মাথা ঘুরে বিছানায় পড়ে যাবে। সেই পড়াই হবে শেষ পড়া। আর উঠা যাবে না। মৃত্যু হবে নিতান্তই অপরিচিত ফিনাইলের গন্ধ মাখা বিছানায়। তারপরও হারুন সরকার চেষ্টা করছে মুখ হাসি হাসি রাখার। ভাবটা এরকম যেন সে ভালো আছে। বেশ ভালো। এরকম ভাব দেখানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, কারণ সে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেয়ার চেষ্টায় আছে। সারাদিন ফিনাইলের গন্ধের মধ্যে পড়ে থাকতে হবে। সন্ধ্যার পর জিনের বোতল নিয়ে বসা যাবে না–এটা ভেবেই তার শরীরে ছটফটানি চলে আসছে। তার মন বলছে বেশি করে তেঁতুল দিয়ে দুগ্লাস জিন খেলেই শরীরে চনমনে ভাব চলে আসবে।
ডাক্তারের সঙ্গে সকালবেলা হারুন সরকার রিলিজ নিয়ে কথা বলেছে। ডাক্তার হতভম্ব মুখ করে বলেছে–আপনি রিলিজ নিতে চান? আপনি জানেন আপনার প্রেসার কত? পালস রেট কত? চোখ গাঢ় হলুদ হয়ে আছে। আমার ধারণা আপনার খারাপ ধরনের জন্ডিস হয়েছে।
হারুন সরকার মিনমিন করে বলেছে, হাসপাতালে থাকলে শরীর আরো বেশি খারাপ করবে।
কেন?
হারুন সরকার চুপ করে গেল। ডাক্তার এবং পুলিশ এই দুই জাতির কাছে তারা যা বলে সেটাই শুদ্ধ। এদের সঙ্গে তর্কে যাওয়া বৃথা। এখন এক মাত্র ভরসা তৈয়ব। একমাত্র সে-ই পারবে তাকে এই জেলখানা থেকে বের করে নিয়ে যেতে।
বসে আছেন কেন? শুয়ে থাকুন। রেস্ট নিন।
হারুন সরকার ডাক্তারের কথা শুনল না। বসে রইল। রাগে মুখের ভেতর ফেনা জমে যাচ্ছে। ফেনার স্বাদ তিক্ত। লক্ষণ ভালো না। মৃত্যুর আগে আগে মুখের ভেতরে তিতা ভাব চলে আসে। রসগোল্লা খেলেও মনে হয় রসে ডুবানো তিতা করলা খাওয়া হচ্ছে।
তৈয়বের উপর প্রচণ্ড রাগ লাগছে। ছাগলটা কখন আসবে? হারুন সরকারের মৃত্যুর পরে আসবে জানাজা পড়াতে। এইসব অকর্মণ্য ছাগলগুলিকে লাথি মেরে বার্মা পাঠিয়ে দেয়া দরকার। মিলিটারিদের গুতা খেয়ে মরুক। হারুন সরকার মনে মনে ঠিক করে ফেলল তৈয়ব যদি দুপুরের খাওয়ার আগে না আসে তাহলে স্বাধীন বাংলা সার্কাসের চাকরি তার শেষ। প্রয়োজনে হারুন সরকার হাট থেকে একটা বুড়া ভেড়া কিনে আনবে। ভেড়াকে ম্যানেজারের চাকরি দেবে কিন্তু তৈয়বকে রাখবে না। তৈয়বের দিন শেষ।
দুপুরের খাওয়ার সময় শেষ হলো, তৈয়ব এলো না। হারুন সরকার সময় আরেকটু বাড়াল–আছর ওয়াক্তে এলেও চাকরি থাকবে। তৈয়ব এলো আছর পার করে। হারুন সরকার বলল, এতক্ষণ ‘…’ ছিড়ছিলা? থাপপড় দিয়ে তোমার দাঁত যদি না ফেলি।
তৈয়ব শান্ত গলায় বলল, আপনার শরীর তো খারাপ। জ্বর বেড়েছে।
হারুন সরকার তুই তুকারিতে চলে গেল। চাপা গলায় ক্রুদ্ধ গর্জন করল, খবর্দার, গায়ে হাত দিবি না।
শুয়ে থাকেন। বসে আছেন কেন?
আবার কথা বলে।
এই রকম করতেছেন কেন?
সন্ধ্যার আগে আমাকে হাসপাতাল থেকে বের করার ব্যবস্থা কর।