অন্য লঞ্চগুলির সঙ্গে এই লঞ্চের কিছু অমিল আছে। এর ডেকে সস্তা ধরনের কিছু সোফা বিছানো। সোফাগুলি নোংরা পলিথিন দিয়ে ঢাকা। লঞ্চের ছাদেও সোফা বিছানো। সোফার সঙ্গে বিশাল আকৃতির দুটি কোলবালিশসহ জাজিম বিছানো। হলুদ রঙের ত্রিপল দিয়ে সোফা জাজিম সবই ঢাকা। লঞ্চের জানালাগুলি কটকটে সবুজ রঙের পর্দা দিয়ে ঢাকা। সারেং-এর জানালার ঠিক নিচে ইংরেজি এবং বাংলায় লেখা প্রাইভেট। ইংরেজি বানানটা ভুল। সেখানে লেখা–PRIVAT।
লঞ্চ মালিকের নাম বশির মোল্লা। এটা তার লাইনের লঞ্চ। তার যখন ফুর্তি করার ইচ্ছা হয় তখন তিনি লাইনের একটা লঞ্চে প্রাইভেট সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দলবল নিয়ে বের হয়ে পড়েন। দ্রলোকের বয়স পাঁচপঞ্চাশ। জীবনের বড় একটা অংশ ফুর্তিতে কাটিয়েছেন। চেহারায় ফুর্তির স্থায়ী ছাপ পড়ে গেছে।
ইবাদত নগরে তিনি এসেছিলেন মনু নদীর ব্রিজ বানানো দেখতে। লোকমুখে শুনেছিলেন দেখার মতো দৃশ্য। বিরাট হুলস্থূল। স্বচক্ষে দেখে তিনি মর্মাহত। নদীতে পাইলিং করা হচ্ছে। ধুমধাম ধুপুস ধাপুস শব্দ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মাথা ধরে গেল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন–শুয়োরের বাচ্চারা কী শুরু করেছে? তার নির্দেশে লঞ্চ অতি দ্রুত সরিয়ে এমন জায়গায় নেয়া হলো যেখানে শব্দ আসে না। সেটা আরেক যন্ত্রণা। লোকালয়ের বাইরের এক জায়গা। গাছগাছালিতে ভরা নদীর পাড়। রাজ্যের পাখি গাছে গাছে কিচমিচ করছে। এদের ক্যাচক্যাচানি পাইলিং-এর শব্দের মতোই যন্ত্রণাদায়ক। পাখিদের ক্যাচক্যাচানি বন্ধ করার জন্যে তাঁর নির্দেশে কয়েকবার ফাঁকা ফায়ার করা হয়েছে।
বশির মোল্লার লাইসেন্স করা দুটি বন্দুক আছে। একটা বিলাতি উইন্ডসর কোম্পানির। আরেকটা জার্মানির দুনলা বন্দুক। বিনা লাইসেন্সের একটা পিস্তলও আছে। পিস্তলটা থাকে তাঁর বালিশের নিচে।
ইবাদত নগরে এসে তিনি ভয়ঙ্কর বিরক্ত হয়েছিলেন। সার্কাস দেখার পর বিরক্তি পুরোপুরি চলে গেছে। সার্কাসের তিনটি মেয়েকেই তার পছন্দ হয়েছে। সবচে বেশি পছন্দ হয়েছে ছোটটিকে। মেয়েটির বিষয়ে কী করা যায় সেটা ঠিক করার জন্যে তিনি সার্কাস কোম্পানির ম্যানেজারকে খবর পাঠিয়েছেন। ম্যানেজার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। এটা ভালো লক্ষণ। বশির মোল্লা মোটামুটি নিশ্চিত যে ধানাই-পানাই করে বেশি সময় নষ্ট করতে হবে না। অল্প সময়েই কার্যোদ্ধার হবে। তিনি জীবনে নানান ধরনের মেয়ের সঙ্গে ফুর্তি-ফার্তা করেছেন। সার্কাসের কোনো মেয়ের সঙ্গে করা হয় নাই। দড়ির উপর যে মেয়ে নাচানাচি করে সে আর দশটা মেয়ের মতো হবে না এটা নিশ্চিত। ফুর্তির নতুন বিষয় মাথায় আসার পর থেকে বশির মোল্লার ভালো লাগছে। পাখির ক্যাচক্যাচানিও এখন আর তত খারাপ লাগছে না। সার্কাস বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটা চিন্তা তাঁর মাথায় চলে এসেছে। তিনি তাঁর শরীরে উত্তেজনা অনুভব করছেন।
আপনে সার্কাসের ম্যানেজার?
জি।
ঘোড়া নিয়া রঙ তামাশা আপনে করেন?
জি।
সত্য সত্যই কি ঘোড়াকে বিবাহ করেছেন? আপনার শরীর থেকে ঘোড়ার গন্ধ আসতেছে। রাগ করেছেন না-কি? আমিও একটু রঙ তামাশা করলাম।
আপনি আমাকে কী জন্যে খবর দিয়ে এনেছেন বললে ভালো হয়।
বলব, এত ব্যস্ত কেন?
আমার মালিক অসুস্থ, উনারে দেখতে যাব।
আপনি তো ডাক্তার না। আপনার দেখা না-দেখা সমান। আপনার নাম কী?
তৈয়ব আলী।
ও আচ্ছা, আপনি মুসলমান? আপনার হিন্দু হিন্দু চেহারা। আপনি মনে হয় গো-মাংস খান না। যারা গো-মাংস খায় না তাদের চেহারার মধ্যে হিন্দু হিন্দু ভাব চলে আসে। আপনি গো-মাংস খান?
খাই।
আরো বেশি করে খাবেন। মদ্যপান করেন?
জি-না।
মদ্যপান করেন না কী জন্যে? ধর্মীয় কারণে?
অভ্যাস নাই।
অভ্যাস না থাকলে অভ্যাস করতে হয়। জন্ম থেকে কেউ অভ্যাস নিয়া আসে না। মেয়েছেলের সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার অভ্যাস আমাদের থাকে না। পরে অভ্যাস হয়। তাদের বিছানায় নিয়ে যাই। আমার কাছে বিদেশী হুইস্কি আছে। নেন, আধা গ্লাস খান। মদ যারা খায় তাদের মধ্যে দ্রুত ভাব ভালোবাসা হয়। আপনের সঙ্গে দ্রুত ভাব ভালোবাসা হওয়া দরকার।
কেন?
আপনার সার্কাসটা আমি কিনে নিতে চাই। নগদ টাকায় কিনব। আমার যৌবনের সামান্য অভাব আছে, টাকার অভাব নাই। ভাটি অঞ্চলে আমার সাতটা জলমহাল আছে। সিজনে দৈনিক মাছ বিক্রি বাবদ লাখ টাকা মুনাফা থাকে।
সার্কাস আমার না। আমার মালিকের। সার্কাস কিনতে চাইলে মালিকের সাথে কথা বলবেন।
ব্যবসা নিয়া আমি বেশি লোকের সঙ্গে কথা বলি না। এক দুইজনের সঙ্গে কথা বলি। আপনের সঙ্গে বললাম আপনি আপনার মালিকের সঙ্গে কথা বলবেন।
কী কথা বলব?
আরে যন্ত্রণা, এতক্ষণ ভেরভের করে কী বললাম? আমি সার্কাস কিনে নিব। আপনি দালালি করবেন। দালালির টাকা পাবেন।
আমার মালিক সার্কাস বেচবে না।
অবশ্যই বেচবে। কেন বেচবে না? ভালো দাম দিলেই বেচবে। ধরেন আপনার একটা শার্ট আছে। শার্টের দাম ২০০ টাকা। আমি যদি বলি আমি দুই হাজার টাকা দিব, আপনার পুরনো শার্ট আমার কাছে বেচে দেন। আপনি বেচবেন না?
আমার শখের শার্ট হলে আমি বেচব না।
তখন আমি বলব আমি বিশ হাজার টাকা দিব। দুইশ টাকা দামের শার্ট, আমি দিব বিশ হাজার টাকা। এখন তো বেচবেন? ব্যবসা বাণিজ্যের লাইনে কথা বলেন। ভাবের লাইনে না। ব্যবসা বাণিজ্যে ভাব চলে না।