জামদানী উত্তর দিল না। খানিকটা ঘুরেও বসল, যেন পয়সা তার চোখে চোখ না রাখতে পারে।
পয়সা বলল, তোমরা কেন আমার উপর রাগ করেছ আমি কি জানতে পারি?
আসমানী এবং জামদানী এই প্রশ্নের জবাব দিল না। আসমানী বিরক্ত চোখে তাকাল।
পয়সা বলল, তোমরা আমার সঙ্গে কথা না বললে আমার কিছু যায় আসে না।
আসমানী বলল, কেন যায় আসে না? তুই কি কথা বলার লোক খুঁজে পেয়েছিস?
পয়সা বলল, হ্যাঁ পেয়েছি।
আসমানী বলল, লালমুখ বান্দরটাকে পেয়েছিস?
পয়সা বলল, হ্যাঁ আমি সার্কাসের মেয়ে। আমার জন্যে বান্দরই ভালো। আমি আগামীকাল আবার তাঁর সঙ্গে গল্প করতে যাব।
জামদানী বলল, তোকে দাওয়াত দিয়েছে?
হ্যাঁ।
কোথায়, তাঁবুতে?
হ্যাঁ, তাঁবুতে। উনার সঙ্গে চা খাব। কফি খাব। উনি যদি হাত ধরতে চান–হাত ধরাধরি করব।
জামদানী বলল, হাত ধরাধরি করবি?
হ্যাঁ করব।
আসমানী শান্ত ভঙ্গিতে বোনের কাছে উঠে এলো। প্রচণ্ড শব্দে বোনের গালে চড় বসিয়ে দিল।
পয়সা চড় খাবার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। সে টুলের উপর থেকে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ে গেল। সে অবাক হয়েছে। তার বড়বোন তার গায়ে হাত তুলতে পারে এটা সে কোনোদিনও ভাবে নি। মেঝে থেকে উঠে সে আগের জায়গায় বসল। পায়ে ফেট্টি বাধা শেষ করল এবং মনে মনে ঠিক করল আগামীকাল সে অবশ্যই ‘মিস্টার পটর পটর’-এর কাছে যাবে। চা খাবে। কফি খাবে। মিস্টার পটর পটর যদি তার হাত ধরতে চায় সে হাত বাড়িয়ে দেবে। তার হাত এমন কোনো পবিত্র হাত না যে কেউ ধরতে পারবে না।
তিন বোনের ডাক পড়েছে। সার্কাসের শেষ দশ মিনিট। এই দশ মিনিট সবাই যেন দমবন্ধ করে বসে থাকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। যার শেষ ভালো তার সব ভালো। মানুষ শুরুটা কখনো মনে রাখে না। শেষটা মনে রাখে।
দড়ির উপর উঠেই পয়সা ঠিক করল সে যে রাগ করেছে এটা সে দু’ বোনকে বুঝিয়ে দেবে। দুই বোন দড়িতে পা দিয়েই বুঝবে ছােটজন রেগে আছে। পয়সা দড়িতে পা ফেলবে অন্যভাবে। দড়ির যেভাবে কাঁপার কথা সেই। ভাবে কাঁপবে না। অন্যভাবে কাঁপবে। দড়ির এই বিশেষ কম্পন অন্য কেউ বুঝতে পারবে না, যারা দড়ির উপর আছে তারা বুঝবে।
দড়িতে পা দিয়েই জামদানীর মুখ শুকিয়ে গেল। সে তাকাল আসমানীর দিকে। দড়ির খেলায় তিন বোনের ভেতর জামদানী সবচে’ দুর্বল। দড়ির কম্পনের একটু উনিশ বিশ হলেই সে নার্ভাস হয়ে পড়ে। আসমানী পয়সার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করল। চোখের অনুরােধ। পয়সা নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিমুখে দু হাত তুলে একটা চক্কর দিয়ে দড়ির দুলুনি ঠিক করে ফেলল। জামদানীর পা কাঁপছিল। তার পা কাঁপা ঠিক হয়ে গেল।
তালিতে তাঁবু ফেটে পড়ছে। আজকের দড়ির খেলা অন্য অনেক দিনের খেলার চেয়েও ভালো হয়েছে। মুহাম্মদ বশির মােল্লা নামের এক মাছের ব্যবসায়ী পয়সার নামে একটা স্বর্ণপদক এবং এক হাজার টাকা পুরস্কার ঘােষণা করেছেন। এই পদক আগামীকাল দেয়া হবে। তালি তালি আবারাে তালি। এই তালি মুহম্মদ বশির মােল্লা নামের মানুষটার জন্যে।
বশির মােল্লাকে মঞ্চে নিয়ে আসা হয়েছে। লুঙ্গি ফতুয়া পরা থলথলে একজন মানুষ। মুখভর্তি পান। পানের রস গড়িয়ে পড়ছে। বশির মােল্লা ফতুয়ায় সেই রস মুছে ফেলছে। পানখাওয়া লাল দাঁত বের করে সে দর্শকদের দিকে হাত নাড়ল। পয়সা বলল-হাদু! বাড়িতে যা। আসমানী এবং জামদানী দু’জনই মুখ কঠিন করে রেখেছে। পয়সার কোনো কথায় তারা হাসবে না। দু’জনেরই হাসি পাচ্ছে। তারা হাসি চেপে রেখেছে। পয়সা বলল, জাম বুবু দেখ কাণ্ড! হাঁদু বাবা হাসছে আর তার ভুঁড়ি কাঁপছে। এমন ভুঁড়ি কাঁপানি হাসি এর আগে দেখেছ?
জামদানী হেসে ফেলল। হাসি ছোঁয়াচে রোগ। জামদানীর সঙ্গে সঙ্গে আসমানীও হাসছে।
হারুন সরকারের সামনে শুকনা মুখে তৈয়ব দাঁড়িয়ে আছে। হারুন সরকারের মনে হচ্ছে খুব জরুরি একটা কথা তৈয়বকে বলা দরকার। জরুরি কথাটা কী সেটাই এখন মনে পড়ছে না। হারুন সরকার খুবই হতাশ বোধ করছে। অথচ কথাটা জরুরি, এখনই বলা দরকার।
তৈয়ব বলল, আপনার অবস্থা তো ভালো না।
কে কী বলছে তা হারুন সরকারের মাথায় ঢুকছে না। সে জরুরি কথাটা মনে করার চেষ্টা করছে। তার ব্যথা আরো বেড়েছে। ঘাড় থেকে ব্যথা নেমে এসেছে বুকে। বুকে চাপ ভাব হচ্ছে। নিঃশ্বাসেও কষ্ট হচ্ছে।
তৈয়ব বলল, আপনাকে তো হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার।
হাসপাতালে যাব না।
এখানে পড়ে থাকলে আপনি মারা যাবেন।
হাসপাতালে গেলেও মারা যাব।
এখানে ভালো হাসপাতাল আছে। আমি খোজ নিয়েছি। মিশনারি হাসপাতাল। চিকিৎসা ভালো।
কথাটা মনে পড়েছে। হারুন কথাটা বলতে যাবে তখনই প্রচণ্ড কাশি শুরু হলো। কাশি যখন শেষ হলো তখন আর কথাটা মনে নেই।
হারুন সরকারকে মিশনারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলো রাত দশটায়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কথাটা তার পুরোপুরি মনে পড়েছে। হাতির বাচ্চাটা তার দেখা হয় নি। তৈয়বকে সে বলতে চেয়েছিল–বাচ্চাটা ঘরে নিয়ে আস, একবার দেখি। এখন আর এইসব কথা মনে করে লাভ নেই। হাসপাতালে হারুন একা। বারান্দায় কালু হাঁটাহাঁটি করছে। কালুকে হাতির কথা বলা অর্থহীন। সে নিশ্চয়ই হাতির বাচ্চাটা হাসপাতালে নিয়ে আসবে না।
মনু নদীর তীরে
মনু নদীর তীরে মাঝারি আকৃতির একটা লঞ্চ বাঁধা আছে। লঞ্চের নাম এমভি সওদাগর।