তোমার নাম কী?
আমার নাম পয়সা।
পয়সা মানে কী?
আপনি এত সুন্দর বাংলা জানেন, পয়সার অর্থ জানেন না?
না।
না জানলে অন্যকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবেন, আমি বলব না।
আচ্ছা আমি জেনে নেব। তুমি কি নদীর মাঝখানে যে পাইলিং হচ্ছে সেটা দেখতে যাবে? স্পিডবোটে করে একটা চক্কর দিয়ে আনব?
হ্যাঁ যাব।
তোমার দুই বোনও কি যাবে? আমার ধারণা স্পিডবোটে করে গেলে ওরাও খুব মজা পাবে।
ওরা যাবে কি-না জানি না। গেলেও অন্যদিন যাবে। আজ আমি একা যাব।
নি পোর্টার খুশি খুশি গলায় বলল, এ দেশের মেয়েরা অপরিচিত পুরুষ মানুষের সঙ্গে এত কথা বলে না। তুমি যে বলছো তাতে আমি অবাক হয়েছি।
পয়সা বলল, আমি সার্কাসের মেয়ে। সার্কাসের মেয়েরা অনেক কিছু পারে যা অন্যরা পারে না।
আসমানী এবং জামদানী অবাক হয়ে দেখল তাদের সবচে ছোট বোন লালমুখ এক বিদেশীর সঙ্গে গটগট করে স্পিডবোটে গিয়ে উঠল। স্পিডবোট চলে যাচ্ছে মাঝনদীতে। লাল মুখটাই স্পিডবোট চালাচ্ছে। সে নানান রকম কায়দা-কানুন করছে। স্পিডবোটকে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে। ডানে নিচ্ছে বায়ে নিচ্ছে।
জামদানী ফিসফিস করে বলল, এইসব কী হচ্ছে?
আসমানী জবাব দিল না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এক্ষুণি ফেরা দরকার। মাগরেবের পরে পরেই শো শুরু হবে। শো শুরু হবার আগেই যদি তিন বোন উপস্থিত না থাকে তাহলে হুলস্থূল হয়ে যাবে।
স্বাধীন বাংলা সার্কাস পার্টির জন্যে আজ মহা শুভ দিন। সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। লাইনে এখনো অনেকে আছে। এদের ঢুকাতে হলে আলাদা করে চাটাই বিছাতে হবে। বিশিষ্ট দ্রলোকেরাও এসেছেন। এসডিও সাহেবের ছেলেমেয়েরা এসেছে। সিও রেভি তাঁর স্ত্রী এবং দুই শালিকে নিয়ে এসেছেন। থানার ওসি সাহেবের স্ত্রী তার কয়েকজন বান্ধবী নিয়ে এসেছেন। এরা সবাই পাস নিয়ে সার্কাস দেখবেন। সবচে ভাললা চেয়ারগুলিতে বসবেন। খেলার মাঝখানে তাদের ঠাণ্ডা কোক-ফান্টা খাওয়াতে হবে। তারপরেও এই ধরনের মানুষ যত আসে তত ভালো, সার্কাসের নাম ফাটে।
শো শুরুর টাইম হয়ে গেছে। তুমুল শব্দে বাদ্য বাজনা বাজছে। বাজনার শব্দ সরাসরি হারুন সরকারের মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার কাছে মনে হচ্ছে মাথা ছিড়ে পড়ে যাবে।
কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার দেখে গেছেন। ডাক্তার শুকনা গলায় বলেছেনহাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। মনে হয় রেসপিরেটরি ট্রাকে ইনফেকশন। সোজা বাংলায় নিউমোনিয়া।
হারুন সরকার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, আমি হাসপাতালে যাব না। ওষুধপত্র যা দেওয়ার দেন। গলায় প্রচণ্ড ব্যথা। গলার ব্যথাটা কমান।
গলায় ব্যথা সকালে ছিল না। সকালে গলার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিকালের পর থেকে গলায় আওয়াজ ফিরে এসেছে। কিন্তু ব্যথা প্রচণ্ড। হারুন সরকারের ধারণা মাথার যন্ত্রণাটাই নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। এখন এসেছে গলায় গলা থেকে নামবে বুকে। বুক থেকে পেটে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, নিউ জেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিলাম। ইনশাল্লাহ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ফল পাবেন।
হারুন সরকার বলল, আমি চব্বিশ ঘণ্টা বাঁচব না। তার আগেই ঘটনা ঘটে যাবে।
এটা হারুন সরকারের কথার কথা না। সন্ধ্যার পর থেকে তার এরকম মনে হচ্ছে।
শো শুরু হয়ে গেছে। হারুন সরকার একা শুয়ে আছে। শো-র সময় সবাইকে শো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। রোগীর পাশে বসে থাকার মতো বাড়তি কেউ তখন থাকে না।
হারুন সরকারের খুবই একা লাগছে এবং ভয় ভয় করছে। ভয়ের কারণ অতি বিচিত্র। তার কাছে মনে হচ্ছে খাটের নিচে কেউ একজন হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। যে বসে আছে সে মানুষের মতো হলেও মানুষ না। তার গা-ভর্তি ললাম। হাতের আঙুল পাঁচটা না। শুয়োপোকার পায়ের মতো অসংখ্য আঙুল। শুয়োপোকার পা যেমন কিলবিল করে, তার আঙুলগুলিও কিলবিল করছে। লোকটা ঘাপটি মেরে বসে আছে সুযোগের অপেক্ষায়। সে হারুন সরকারকে তার কিলবিল আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেবে। কাজটা সে কখন করবে তা-ও হারুন সরকার জানে, যখন ঘরে কেউ থাকবে না এবং যখন হারুন সরকার চোখ বন্ধ করে থাকবে। এই ভয়েই হারুন সরকার চোখ বন্ধ করতে পারছে না। যদিও তাকিয়ে থাকতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। হারুন সরকার হতাশ গলায় ডাকল, তৈয়ব, তৈয়ব!
তৈয়ব স্টেজের মাঝখানে। সে তার ঘোড়া নিয়ে নানাবিদ রসিকতা করছে। দর্শকরা হেসে এ ওর গায়ে গড়াগড়ি করছে। তৈয়ব আজ নতুন একটা আইটেম চেষ্টা করছে। ঘোড়ার ঠোটে লিপস্টিক দেয়া। ঘোড়ার ভেজা ঠোঁটে লিপস্টিক বসছে না এটাই সমস্যা। লিপস্টিক বসলে আরো মজা হতো। তৈয়ব ঘোড়ার গলা জড়িয়ে ধরে গাঢ় স্বরে বলছে–ওগো রাগ করে থেকো না গো! তোমার জন্যে ছুনু এনেছি, পাউডার এনেছি, লিপস্টিক এনেছি। আমার দিকে তাকায়ে একটু হাস। লক্ষ্মী সোনামনি।
ঘোড়া ঘোৎ করে একটা শব্দ করল। তাঁবুর সমস্ত লোক একসঙ্গে হেসে উঠল।
পয়সা সাজঘরে কাপড় বদলাচ্ছে। তাদের ডাক আসতে এখনো অনেক। দেরি। এত আগে কাপড় পরে বসে থাকতে তার ভালো লাগে না। আজ বাধ্য হয়ে পরছে। নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা। কারণ নদীর ঘাট থেকে ফেরার পর তার দুই বোন তার সঙ্গে কথা বলছে না। কোনো কথাই বলছে না। কথা না বলার মতো বড় কোনো অপরাধ তো সে করে নি। একজন বিদেশীর সঙ্গে স্পিডবোটে করে নদীতে কয়েকটা চক্কর দিয়েছে।
পয়সা পায়ে ফেট্টি বাঁধতে বাঁধতে বলল, তৈয়ব চাচাকে দেখে মনেই হয় তিনি এত মজা করতে পারেন। কী গম্ভীর মানুষ! দেখলেই ভয় লাগে। তাই জাম বুবু?