জমির আলী অপমান গায়ে মাখল না। যারা ফকিরি ব্যবসায় নামে তাদের অপমান গায়ে মাখতে হয় না। তাদের হতে হয় হাঁসের মতো। পানির মধ্যে বাস কিন্তু শরীর শুকনা। জমির আলী কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে বলল–নয়া আবুরে মধু খাওয়াইছ? মধু না খাওয়াইলে জবান মিষ্ট হবে না। জবান হবে কাকপক্ষীর মতো কর্কশ।
আছিয়া বলল, আমারে কি আপনে মধুর চাকের উপরে বসাইয়া রাখছেন? চাক ভাইঙ্গা আবুর মুখে মধু দিব?
জমির আলী চিন্তিত মুখে বলল, মুখে মধু দেয়া প্রয়োজন ছিল। মেয়ে মানুষের আসল পরিচয় জবানে। যার যত মিষ্ট জবান সে তত পেয়ারা।
সামনে থাইক্যা যান কইলাম।
দুবলা শইল্যে চিল্লাফাল্লা করবা না। পেটের নাড়িতে টান পড়ব। পুয়াতি মেয়েছেলের নাড়িতে টান পড়লে বিরাট সমস্যা।
আরেব্বাসরে, আমরার কবিরাজ আইছে। সামনে থাইক্যা না গেলে আফনের খবর আছে।
জমির আলী ঘর থেকে বের হলো। সন্তানের মুখ দেখে সে খুবই আনন্দিত। গায়ের রঙ মাশাল্লা ভালো হয়েছে। চৈত্র মাসের সকালের রোদের মতো রঙ। আসমানী এবং জামদানী দুই জনের গায়ের রঙ একটু ময়লার দিকে। এই মেয়ে রঙের দিকে উড়াল দিয়েছে। জমির আলী পেছনের উঠানে গিয়ে মধুর গলায় ডাকল–আমার দুই মেয়ে কই? কই আমার আসি, কই আমার জামি?
দুই মেয়ে তৎক্ষণাৎ ছুটে এলো। দুই মেয়েই বাবাঅন্তঃপ্রাণ। মার ধমক খেয়ে তারা বাড়ির উত্তরে বাঁশঝাড়ে চুপচাপ বসে ছিল। দুজনেরই খুব ইচ্ছা নয়া বোনকে কোলে নেয়। কোলে নেয়া দূরের কথা, ভালোমতো দেখতেই পারে নি। আছিয়া ধমকে তাদের বাড়িছাড়া করেছে।
জমির আলী মেয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরার সবচে ছোট ভইনটার নাম আমি দিলাম পয়সা। কী, নাম কেমুন হয়েছে?
আসমানী বলল, পয়সা আবার কেমুন নাম?
খুবই সৌন্দর্য নাম। ডাক নাম পয়সা, ভালো নাম মোসাম্মত পয়সা কুমারী। এখন বলো, নাম ভালো হইছে না?
হুঁ।
এখন যাও চুলা ধরাও। খিচুড়ি রান্ধা হইব। ইসপিসাল খিচুড়ি। ঘরে চাউল ডাউলের অবস্থা কী দেখ। না থাকলে দোকানে যাইবা।
দুই বোনের চোখ আনন্দে চকচক করতে লাগল। তারা তাদের বাবার হাতের খিচুড়ির ভক্ত। খিচুড়ি রান্নার প্রক্রিয়ারও ভক্ত। হাঁড়িতে জ্বাল উঠতে থাকে। হাঁড়ি ঘিরে সবাই বসে আছে। জমির আলী হাসিমুখে বলে–আরেকটা কিছু দিলে ভালো হইত। ঘরে আর কিছু আছে? না থাকলে দুই ভইন দুইটা যাও দৌড়াইতে থাকবা, চোখের সামনে সবজি বা সবজি কিসিমের যা পাইবা নিয়া আসবা। খালি কাঁঠাল পাতা আর ঘাস আনবা না। এই গুলান গরু-ছাগলের খাদ্য।
দুই মেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বের হয়ে যায়। তাদের বড়ই মজা লাগে।
জমির আলী খিচুড়ি রাঁধতে বসেছে। আজকের খিচুড়ি ইসপিসাল, খিচুড়িতে দুটা ডিম ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আসমানী এবং জামদানী চোখ বড় বড় করে বাবার দুপাশে বসেছে। মাঝে মাঝে হাঁড়ির ঢাকনা খোলা হয়। খিচুড়ির সুঘ্রাণ নাকে এসে লাগে–তাদের শরীর ঝিমঝিম করে। এরা দুজনই সকাল থেকে কিছু খায় নি। আছিয়া প্রসব-বেদনায় কাতর হয়ে ছটফট করছিল। দুটি ক্ষুধার্ত শিশুর কথা তার একবারও মনে হয় নি। মনে হলেও কিছু করা যেত না। ঘরে কোনো খাবার ছিল না।
জমির আলী বলল, বলো দেখি জগতের সবচে ভালো খাদ্যের নাম কী?
আসমানী এবং জামদানী এক সঙ্গে উত্তর দিল, খিচুড়ি।
জমির আলী আনন্দিত স্বরে বলল, হয়েছে। দুইজনেই পাস। ফাস ডিভিসনে পাস। এখন বলো দেখি খিচুড়ি কী জন্যে সবচে ভালো খাদ্য?
জানি না। চিন্তা-ভাবনা কইরা বলো।
তুমি বলো।
জমির আলী আগ্রহ নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে খিচুড়ি-মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করে। তার দুই কন্যা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। তারা তাদের বাবার জ্ঞান ও প্রতিভায় বিস্মিত বোধ করে।
খিচুড়ি জগতের সবচে ভালো খাদ্য, কারণ আল্লাহপাক খিচুড়ি পছন্দ করেন। জগৎ-সংসারের দিকে চাইয়া দেখ–যে-দিকে চোখ যায় সেদিকে খিচুড়ি। কালা মানুষ, ধলা মানুষ, শ্যামলা মানুষ মানুষের খিচুড়ি। গাছপালার কথা বিবেচনা কর–আম গাছ, জাম গাছ, কাঁঠাল গাছ, তেঁতুল গাছ। গাছের খিচুড়ি। ঠিক কি-না?
হুঁ।
জগাই বিরাট এক খিচুড়ি। আল্লাহপাক কী করেছে শোন–বিরাট এক হাঁড়ি জ্বালে বসাইছে। সেই হাঁড়ির মধ্যে মানুষ, গরু, ছাগল, গাছপালা সব দিয়া খালি ঘুঁটতাছে।
জামদানী বলল, কী জন্যে?
উনার মনের কথা আমি কেমনে বলব? আমি ফকির মানুষ–আমার কি জ্ঞান বুদ্ধি আছে?
আসমানী বলল, বাপজান, তোমার বেজায় জ্ঞান বুদ্ধি।
জমির আলী মেয়ের কথায় আনন্দিত বোধ করে। সংসার তার কাছে মধুর বোধ হয়। নতুন শিশুর আগমনে অভাবের সংসার যে আরো জটিল হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। নয়া আবুর খানা খাদ্যের পিছনে বাড়তি খরচ নাই। নয়া আবুর খানা খাদ্যের ব্যবস্থা আল্লাহপাক নিজে করেন। মায়ের বুকে দুধ দিয়ে দেন। আল্লাহপাকের নাম রহমান রহিম তো খামাখা হয় নাই। আল্লাহপাক খামাখার মধ্যে নাই।
জমির আলীর ক্ষীণ সন্দেহ ছিল রাগ করে আছিয়া খিচুড়ি খাবে না। কিন্তু জমির আলীকে অবাক করে দিয়ে সে খিচুড়ি খুবই আগ্রহ করে খেল। জমির আলী বলল, টেস ভালো হইছে না?
আছিয়া জবাব দিল না।
জমির আলী বলল, চাউলের বদলে গম দিয়াও খিচুড়ি হয়। গমের খিচুড়ির টেস আরো বেশি, তয় গমের খিচুড়ির মধ্যে মাংস দেয়া লাগে। দেখি তোমরারে একদিন গমের খিচুড়ি খাওয়াব। ইনশাল্লাহ।
আছিয়া থালার খিচুড়ি শেষ করে ফেলেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার ক্ষুধা এখনো আছে। জমির আলী বলল, আরেক হাত খিচুড়ি দেই?