পয়সা মুগ্ধ গলায় বলল, কী অবস্থা! জাম বুবু দেখ দেখ, রেললাইন বসায়ে ফেলেছে। রেললাইনের উপরে এইগুলান কী?
জামদানী বলল, আমি কি জানি? তুই যতটুক জানিস, আমি ততটুকই জানি।
ধুরুম ধারুম শব্দ কীসের?
জানি না।
জাম বুবু দেখ, চায়ের দোকান বসেছে। বুবু আস, চা খাই।
তারা খুব আনন্দ করে চা খেল। পয়সা বলল, চল একটা নৌকা ভাড়া করে যেখানে পিলার বসাচ্ছে ঐখানে যাই।
আসমানী বলল, কোনো দরকার নাই।
পয়সা বলল, দরকার আছে।
আসমানী বলল, কী দরকার?
আমার কাছে গিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। এইটাই দরকার। বুবু, স্পিড বোটগুলো দেখেছ কত সুন্দর! সুন্দর না?
জামদানী বলল, হুঁ সুন্দর।
পয়সা বলল, দেখে মনে হচ্ছে বিরাট মজার সার্কাস।
আসমানী বলল, উল্টা-পাল্টা কথা বলিস না তো পয়সা। সার্কাস আর ব্রিজ তৈরি এক জিনিস?
আমার কাছে এক জিনিস। চল নৌকা ভাড়া করি।
আসমানী বলল, না।
পয়সা বলল, তোমরা না গেলে আমি একা যাব।
সাহস থাকলে যা একা।
তোমরা কি ভেবেছ আমার সাহস নেই? তোমাদের ছাড়া একা যেতে পারব না? আমি কিন্তু যেতে পারব।
জামদানী বলল, পঞ্চাশ টাকা বাজি, যেতে পারবি না।
পয়সা গটগট করে এগোচ্ছে। একবারও পেছনের দিকে তাকাচ্ছে না। জামদানী ভীত গলায় বলল, বুবু, ও সত্যি সত্যি চলে যাবে না তো?
আসমানী বলল, না, ও নদীর পাড় পর্যন্ত যাবে। নৌকার মাঝিদের সঙ্গে কথা বলবে। ভাব করবে যেন সত্যি সত্যি নৌকায় উঠছে।
যদি সত্যি সত্যি যায়?
গেলে যাবে। একা একা নৌকা নিয়ে নদীর মাঝখান পর্যন্ত যাওয়ার সাহস থাকা তো ভালোই।
জামদানী বলল, চল আমরাও যাই।
না।
আমরা কী করব। এখানে দাঁড়িয়ে থাকব?
হুঁ। আয় এক কাজ করি, চায়ের দোকানটার আড়ালে চলে যাই। যেন পয়সা আমাদের না দেখতে পায়। যেন ভাবে আমরা তাকে ফেলে চলে গেছি।
দুই বোন চায়ের দোকানের আড়ালে চলে গেল।
পয়সার খুব ইচ্ছা করছে পেছনে তাকিয়ে দেখতে তার দুই বোন কী করছে, কিন্তু সে তাকাচ্ছে না। সে ঠিক করে ফেলেছে নৌকা ভাড়া পাওয়া গেলে মাঝ নদী পর্যন্ত যাবে। তার দুই বোন ভয়ে আধমরা হয়ে যাবে। মোটামুটি মজার একটা ব্যাপার। তারা তিন বোন দড়ির উপর ভয়ঙ্কর খেলা দেখায়। তখন তাদের খুব সাহসী মনে হয়। আসলে তারা তিনজনই খুব ভীতু। এক খাট ছাড়া তিনজন ঘুমোতে পারে না। সেই ঘুম নিয়েও সমস্যা–মাঝখানে কে শোবে? যারা দুই পাশে শোয় তাদের সারাক্ষণ ভূতের ভয় করে। এই বুঝি খাটের নিচ থেকে মরা মানুষের হাত ছুঁয়ে দিল।
তিনজনের কেউই সাঁতার জানে না, কাজেই পানিকেও খুব ভয়। নৌকায় উঠলেই তাদের মনে হয় এই বুঝি বড় একটা ঢেউ এসে নৌকা কাত করে দিল। সেখানে একা একা মাঝ নদী পর্যন্ত যাওয়াটা খুব সাহসী কাজ। অনেকদিন থেকেই পয়সার ইচ্ছা সে সাহসী কোনো কাজ করে। সুযোগটা পাওয়া গেছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
পাড় থেকে মাঝ নদী পর্যন্ত যাবার নৌকা পাওয়া যাচ্ছে। ভাড়াও বেশি না। রিজার্ভ নৌকায় গেলে বিশ টাকা ভাড়া। দলের সঙ্গে গেলে দু টাকা। খেয়াপারানি নৌকাও আছে। তার ভাড়া এক টাকা। এপাড় থেকে ওপাড়ে গেলে মাঝনদীতে ব্রিজ বানানোর কর্মকাণ্ড দেখা যায়।
একটা সমস্যা অবশ্যি আছে। মাঝে মাঝে স্পিডবোট অতি দ্রুত আসা যাওয়া করছে। তখন বিরাট ঢেউ উঠছে। ছোট ছোট নৌকাগুলি এমনভাবে দুলছে দেখে মনে হয় এই বুঝি ডুবে গেল।
দেশী নৌকার ঘাট ছেড়ে পয়সা এখন এগোচ্ছে স্পিডবোটগুলির দিকে। কাছ থেকে দেখবে এই তার পরিকল্পনা। পয়সা ঠিক করে রেখেছে স্পিডবোটগুলির কাছে গিয়ে সে একবার পেছন দিকে তাকাবে।
হ্যালো মিস!
পয়সা ভয়ঙ্কর চমকে গেল। বিদেশী এক সাহেব পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ এত নীল যে মনে হচ্ছে নীল রঙ চোখ থেকে গড়িয়ে এখনি নিচে পড়ে যাবে।
সাহেব পরিষ্কার বাংলায় বলল, সার্কাসে আপনার দড়ির খেলা মনোহর হয়েছে।
আশ্চর্য, বোরকা পরা অবস্থায় এই সাহেব তাকে চিনল কীভাবে? সাহেবও কি হাতির মতো? পয়সা বোরকার পর্দা সরিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল–আপনি কী করে আমাকে চিনলেন?
তিনটা বোরকা পরা মেয়ে হাঁটে। দূর থেকে দেখে চিনেছি।
আপনি এত সুন্দর বাংলা কার কাছে শিখেছেন?
আমি তিন বছর এই দেশে আছি। আমি সবার সঙ্গে খুব বেশি কথা বলি। এই জন্যে সুন্দর বাংলা বলি। আমি গ্রাম্য বাংলাও বলতে পারি।
বলুন তো শুনি।
ভাত খাইচুইন–এর অর্থ ভাত খেয়েছেন? ময়মনসিংহের ভাষা।
আপনি এখানে কী করেন?
আমি নদী শাসন করি।
নদী কি দুষ্ট ছেলে যে নদী শাসন করবেন?
নদী দুষ্ট ছেলে না। নদী দুষ্ট মেয়ে। বড়ই খেয়ালি। তাকে সব সময় শাসনে রাখতে হয়।
কীভাবে শাসন করেন। বেত দিয়ে মারেন? না-কি ধমক দেন?
সাহেব হাসছে। হাসির শব্দ এতই জোরালো যে অনেক দূরের লোকজনও মাথা ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। পয়সা খুবই মজা পাচ্ছে। একজন সাহেবের সঙ্গে কথা বলছে–মজাটা এই জন্যে না, মজা লাগছে এই কারণে যে তার দুই বোন দূর থেকে দৃশ্যটা দেখে নিশ্চয়ই চমকাচ্ছে। ভয়ে অস্থির হচ্ছে। তারা আরো বেশি ঘাবড়ে যাবে যদি সে এই সাহেবের সঙ্গে স্পিডবোটে করে একটা চক্কর দিয়ে আসে।
আমার নাম নি পোর্টার।
বলেই সাহেব হাত বাড়াল। হাত যে হ্যান্ডশেক করার জন্যে বাড়ানো হয়েছে এটা বুঝতে পয়সার কিছুক্ষণ সময় লাগল। ছেলেরা ছেলেরা হ্যান্ডশেক করে কিন্তু ছেলে এবং মেয়েও কি হ্যান্ডশেক করে? পয়সা খুবই অস্বস্তি এবং লজ্জার সঙ্গে হাত বাড়াল। অস্বস্তির সঙ্গে মজার ভাবটাও তার মধ্যে আছে। দেখুক তার দুই বোন। দেখে আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাক।