বোরকা পরে তিনবোন কোথায় যাবে এখনো ঠিক করা হয় নি। খুব বেশিদূর যাবে এরকম মনে হয় না। এরা সার্কাসের তাঁবুর আশেপাশেই ঘোরাফেরা করবে। সার্কাস দলের মানুষদের এই নিয়ম। এক তাঁবুর নিচে দিনের পর দিন থাকার কারণে তাদের নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বন্ধন তৈরি হয়। পুতো দল ছাড়া বের হয়ে এরা স্বস্তি বোধ করে না। যেখানেই যাক দৃষ্টিসীমার ভেতর সার্কাসের তাঁবু থাকতে হবে।
আসমানী বলল, একটা কাজ করলে কেমন হয়। চল এলং-কে দেখে তারপর যাই। একটা মজা করব।
জামদানী বলল, কী মজা?
আসমানী বলল, এখন তো আমরা বোরকা পরা। মুখের পর্দা ফেলে দিলে হাতি দেখতে পারবে না কে কোন জন। দেখি তারপরেও সে পয়সাকে চিনতে পারে কি-না।
পয়সা বলল, পারবে।
জামদানী বলল, পারবে না, একশ টাকা বাজি।
পয়সা বলল, পঞ্চাশ টাকা বাজি।
জামদানী বলল, পঞ্চাশ টাকা না, একশ টাকা। সাহস থাকলে একশ টাকা বাজি ধর।
আমার কাছে একশ টাকা নাই। আমার কাছে যা আছে আমি সেটাই তো বাজিতে ধরব।
আচ্ছা যা, পঞ্চাশ টাকাই বাজি।
তাহলে আম বুবুর কাছে পঞ্চাশ টাকা জমা রাখ।
জমা রাখার দরকার কী?
পয়সা বলল, আমি একবার তোমার কাছে বিশ টাকা জিতেছিলাম, তুমি আমাকে সেই টাকা দাও নাই।
এইবার তুই যদি বাজিতে জিতিস তাহলে ঐ বিশ টাকাও দিয়ে দেব। আর যদি হারিস তাহলে কোনোদিনও ঐ বিশ টাকার কথা তুলতে পারবি না।
আচ্ছা যাও তুলব না।
জামদানী বাজিতে হেরে গেল। হাতি আসমানী জামদানী কাউকেই কাছে। আসতে দিচ্ছে না অথচ পয়সাকে কিছুই বলছে না। পয়সা তীক্ষ গলায় ডাকল–এলং, ঐ এলং। হাতির বাচ্চা হাতির চারপায়ের মাঝখানে লুকিয়ে আছে। সেখান থেকে শুড় বের করে পয়সাকে ছুঁয়ে দিল। পয়সা হেসে ভেঙে পড়েছে। পয়সার সঙ্গে সঙ্গে দুবোনও হাসছে।
তিনজনের হাসির শব্দ হারুন সরকারের মাথায় তীরের ফলার মতো বিধছে। সে চিৎকার করে বলল, হাসি বন্ধ। যদিও সে চিৎকার করছে কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনোই আওয়াজ বের হলো না। তার অবস্থা খুবই খারাপ। যন্ত্রণায় মাথা ছিড়ে পড়ে যাচ্ছে। রাতে সে বমির উপর পড়েছিল। এখন বমি নেই। কালু সব পরিষ্কার করেছে। ভেজা গামছা দিয়ে গা মুছিয়ে দিয়েছে। এখনো হারুন সরকারের মাথায় ভেজা গামছা। শীতে শরীর কাঁপছে। জ্বর আসার লক্ষণ।
এই অবস্থায় মাথায় ভেজা গামছা রাখা ঠিক না। ভেজা গামছার কারণে মাথার যন্ত্রণাটা সামান্য কম লাগে বলে গামছা সরানো যাচ্ছে না। গায়ে চাদর দিয়ে দিলে শীতের কাঁপুনি বন্ধ হতো। দিয়ে দিবে কে? কালু গেছে ডাক্তার আনতে। হারুন সরকার চাপা গলায় ডাকল, কালু, কালু! সে জানে কালু আশেপাশে নেই। তারপরেও তাকে ডাকার কারণ গলার স্বর ফিরে এসেছে কিনা তা পরীক্ষা করা। গলার স্বর ফিরে নি। ফ্যাসফাস আওয়াজ বের হচ্ছে। কেউ যে তাকে দেখতে আসবে সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। যখন-তখন তার ঘরে ঢোকা নিষেধ আছে।
মেয়ে তিনটা এখনো হাসছে। হাতির বাচ্চা দেখে হাসছে এটা বোঝা যাচ্ছে। বাচ্চাটা এখনো দেখা হলো না। সবাই দেখেছে অথচ হাতির মালিক সে-ই দেখে নি– এটা বিরাট একটা আফসোসের ব্যাপার। হাতির বাচ্চা এবং হাতির মা এই দুজনকে নিয়ে কোনো একটা খেলা বের করতে হবে। বল ছোড়াছুড়ি খেলা। মা-হাতি একটা বল ছুড়ে মারল তার বাচ্চার দিকে, বাচ্চা সেই বল ফেরত পাঠাল। লাল রঙের বিরাট একটা বল লাগবে। সেই বল খুব ভারী হলেও হবে না। আবার হালকা হলেও হবে না। হাতি অতি বুদ্ধিমান প্রাণী, যেকোনো খেলা সে অতি দ্রুত শিখে ফেলে। কেউ কেউ আবার নিজে নিজেও খেলা বের করে।
হারুন সরকার কল্পনায় দেখছে–হাতি এবং হাতির বাচ্চা লাল বল ছোড়াছুড়ির খেলা খেলছে। এই কল্পনা করাটা ঠিক হয় নি। কড়া লাল রঙ এখন মাথার ভেতর ঢুকে দপদপ করছে। হারুন সরকার কল্পনায় বলের রঙ লাল থেকে নীল করল। তাতে লাভ হলো না। রঙ বদলাল না। বরং আরো গাঢ় হলো। মাথার উপর রাখা ভেজা গামছা শুকিয়ে গেছে। আবারো ভিজিয়ে মাথার উপর দেয়া দরকার। কে দেবে? কালু হারামজাদা সেই যে গিয়েছে আর আসার নাম নেই। ডাক্তার আনতে হিন্দুস্থান চলে গেছে কি-না কে জানে। একটা শান্তি হয়েছে। মেয়ে তিনটার হাসাহাসি শোনা যাচ্ছে না। কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে না। হারুন সরকার আবার ডাকল, কালু, কালু! কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। আগে ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ হতো। এখন সে আওয়াজও নেই। মৃত্যুর আগে আগে মানুষের জবান বন্ধ হয়। তারও কি জবান বন্ধ হয়ে গেছে! সে মারা যাচ্ছে না তো? সে দুরুদে শেফা পড়ার চেষ্টা করল। শেফা’ শব্দের অর্থ আরোগ্য। এই দুরুদ পাঠে রোগমুক্তি ঘটে।
দুরুদটা হারুন সরকারের জানা আছে। এখন মনে আসছে না। প্রথম শব্দটা মনে হলেই বাকি সবটা মনে হবে। প্রথম শব্দটাই মনে পড়ছে না। আল্লাহুম্মা দিয়ে কি শুরু হয়েছে? আল্লাহুম্মার পরে কী? সাল্লিআলা?
তিন কন্যা চলে এসেছে মনু নদীর পাড়ে। সেখানে বিরাট কর্মযজ্ঞ। একই সঙ্গে নদী শাসন হচ্ছে। বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ড শুভেচ্ছা সেতুর জন্যে পাইলিং করা হচ্ছে। নদীর চরে গােটা পঁচিশেক নানান আকৃতির নানান বর্ণের তাঁবু। মাটিকাটা শ্রমিকদের জন্যে লম্বা টিনশেডঝকঝকে নতুন টিনে আলো ঝলমল করছে। কয়েকটা দৈত্যাকৃতি ক্রেন। ক্রেন চলাচল করে রেললাইনের উপর দিয়ে। ওয়ার্কশপ থেকে নদীর পাড় পর্যন্ত রেললাইন বসানো হয়েছে। বিপুল কর্মকাণ্ড দেখতে ভালো লাগে। দূর দূরান্ত থেকে শুধুমাত্র ব্রিজ বানানো দেখার জন্যে লোকজন আসছে।