জামদানী বলল, কী জন্যে ডেকেছেন?
হারুন বলল, খুব জরুরি একটা কাজে ডেকেছি। জরুরি কাজটা কী ভুলে গেছি। দাঁড়ায়ে আছে কেন, বসো।
জামদানী বসল। হারুন আগ্রহ নিয়ে বলল, নেশা করলে কী হয় জানো? অল্প নেশা করলে স্মৃতিশক্তি বাড়ে। নেশা একটু বেশি হয়ে গেলে স্মৃতিশক্তি ধুপ করে পড়ে যায়। আমারটা ধুপ করে পড়ে গেছে। ও আচ্ছা! মনে পড়েছে–তুমি বলেছিলে হাতির কী অসুখ হয়েছে তুমি জানো। সাপের অসুখের বিষয়ে যে জানে তাকে বলে সর্পরাজ। তোমার টাইটেল দিলাম হস্তিরানী। হা হা হা।
হারুন হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থায় চলে গেল। হাসি থেকে তার হেঁচকি উঠে গেল। হেঁচকির ফাঁকে ফাঁকে বলল, বলো দেখি হস্তিরানী, আমার হাতির অসুখটা কী?
জামদানী শান্ত গলায় বলল, হাতিটার সন্তান হবে, প্রসব ব্যথা উঠেছে।
হারুন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কী বললা?
জামদানী বলল, হাতিটার সন্তান হবে।
হারুন বলল, উল্টা পাল্টা কথা বলে তুমি আমার নেশা কাটায়ে দিয়েছ। অনেক কষ্টের নেশা, তৈরি করতে সময় লাগে। যাও, ঘুমাতে যাও। একটা কথা মনে আসল আর বলে ফেললা–এটা ঠিক না। তুমি হাতির লেডি ডাক্তার না। যাও আমার সামনে থেকে।
হারুন অনেকদিন পর মনের আনন্দে নেশা করল। জিনের পুরো বোতল শেষ করার পর লুকিয়ে রাখা ভদকার একটা বোতল বের করা হলো। একা একা মদ্যপান করা যায় না। এখন হারুনের সঙ্গী কালু। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কালুকে হারুনের বন্ধুর মতো লাগছে। সে যে বাবুর্চির অ্যাসিসটেন্ট, তার প্রধান কাজ চুলায় লাকড়ি দেয়া, খড়ি ফাড়া–এটা আর মনে হচ্ছে না। বরং হারুনের মনে হচ্ছে কালু যথেষ্ট জ্ঞানী একজন মানুষ। তার সঙ্গে সুখ দুঃখের কথা যেমন আলাপ করা যায় তেমনি জটিল সমস্যার সমাধানও চাওয়া যায়। হারুন কালুর পিঠে হাত রেখে বলল, জহির সাহেবের মৃত্যুতে বড় কষ্ট পেয়েছি। কালু বলল, কষ্ট পাওয়ার কথা। কতদিনের পুরনো চিনা জানা লোক।
হারুন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কেউ নাই, একটা লোক ফুট করে মরে গেল।
কালু বলল, এটা খারাপ না। দুঃখ করার কেউ নাই।
হারুন বলল, দুঃখ করার একেবারে কেউ না থাকাটাও ঠিক না। এক দুইজন থাকবে, মৃত্যুর পরে ভেউ ভেউ করে কাঁদবে।
কালু বলল, অবশ্যই।
হারুন বলল, আমারও তো জহির সাবের মতোই অবস্থা। তারও কেউ ছিল না। আমারও কেউ নাই। সেও ছিল হাতির মালিক। আমিও হাতির মালিক। এখন ইচ্ছা করতেছে ঘর-সংসার করি। বয়সটা হয়ে গেছে সমস্যা পাঁচপঞ্চাশ।
কালু বলল, পাঁচপঞ্চাশ কোনো বয়সই না।
হারুন বলল, জামদানীর মতো একটা মেয়ে পাওয়া গেলে ভালো হতো। খুবই ভালো একটা মেয়ে। মাথায় সামান্য গণ্ডগোল আছে। এটা থাকবেই। সব ভালো মানুষের মাথায় সামান্য গণ্ডগোল থাকে।
কালু বলল, অতি সত্য কথা। একমাত্র আপনাকে দেখলাম–অতি ভালোমানুষ কিন্তু মাথা পরিষ্কার। মাথায় কোনো গণ্ডগোল নাই।
মাথায় গণ্ডগোল নাই তোমাকে কে বলল! গণ্ডগোল অবশ্যই আছে। গণ্ডগোল না থাকলে নিজের মেয়ের মতো যাকে বড় করেছি তাকে বিয়ে করতে চাই। ছিঃ ছিঃ, ভাবতেও লজ্জা।
কালু বলল, আরেক গ্লাস খান, তাহলে লজ্জাটা কমে যাবে।
দাও, আরেক গ্লাস। আজ বমি না হওয়া পর্যন্ত খাব। যা থাকে কপালে।
হারুন তার কথা রাখল, বমি করে ঘর ভাসিয়ে না দেয়া পর্যন্ত ক্রমাগত খেয়ে গেল। রাত তিনটায় সে এবং কালু যখন নিজেদের বমির উপর অর্ধচেতন হয়ে পড়ে আছে তখন খবর এলো–হাতির একটা মেয়ে বাচ্চা হয়েছে। হারুন খবরটার গুরুত্ব কিছুই বুঝল না। মাথা তুলে খবরটা শুনে আবারো বমির উপর শুয়ে পড়ল।
তিনজনই বোরকা পরেছে
তিনজনই বোরকা পরেছে।
পয়সার খুব মজা লাগছে। সে সবাইকে দেখছে, তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে। এখন মনের আনন্দে ঘোরাফেরা করা যায়। কেউ বুঝবে না সে কে। তবে ইবাদত নগর ছছাট জায়গা। ছোট জায়গায় বোরকা পরা তিনজন হাঁটাহাঁটি করছে এটা চোখে পড়বেই। চোখে পড়লেও সমস্যা হবে না। কেউ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করবে না, আপনারা কে? তারা যে সার্কাসের মেয়ে এটা কি বুঝবে? বুদ্ধি থাকলে বুঝবে।
জামদানী বলল, আমার দম বন্ধ লাগে।
পয়সা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে। দমবন্ধ লাগার কথায় হাসির কিছু নেই। পয়সার সমস্যা হলো যখন তার মন ভালো থাকে তখন যে-কোনো কথায় সে হাসে। আজ তার মন ভালো। মন ভালো হবার প্রধান কারণ–হাতি তার বাচ্চার কাছে কাউকেই ঘেঁসতে দিচ্ছে না। শুধু পয়সার ব্যাপারে কিছু বলছে না। পুরো সার্কাসের দলে পয়সা একমাত্র মেয়ে যাকে হাতি তার বাচ্চার কাছে যেতে দিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, হাতিটার সঙ্গে পয়সার ঘনিষ্ঠতাই সবচে কম।
আসমানী বলল, পয়সা, হাসি বন্ধ কর। খামাখা হাসি।
পয়সা বলল, খামাখা হাসি না। জাম বুবুর দমবন্ধ এই জন্যে হাসি।
পয়সা জামদানীকে সংক্ষেপ করে ডাকে জাম বুবু। জামের সঙ্গে মিলিয়ে আসমানীকে ডাকে আম বুবু। সবকিছুর একটা নাম দিয়ে দেয়ার প্রবণতা পয়সার আছে। হাতির বাচ্চার নাম সে দিয়েছে এলং। জামদানীর সঙ্গে এই নাম নিয়ে কথা কাটাকাটিও হয়েছে। জামদানী বলেছে, এলং আবার কী নাম? বাচ্চাটা এত সুন্দর। সুন্দর একটা নাম দে। পয়সা মুখ বাঁকা করে বলেছে–সুন্দর নাম তুমি দাও। আমি এরে ডাকব এলং।
জামদানীর মেজাজ খারাপ হয়েছে, কারণ সে জানে যত সুন্দর নামই দেয়া হোক শেষপর্যন্ত পয়সার দেয়া নামই স্থায়ী হয়ে যাবে। এত সুন্দর একটা বাচ্চাকে সবাই এলং এলং ডাকবে। পয়সা যে নাম দেয় সেটাই শেষপর্যন্ত স্থায়ী হয়ে যায়। সার্কাস দলের ম্যানেজার তৈয়বের নাম সে দিয়েছে কুতুকুতু। দলের সবাই ম্যানেজারকে এখন আড়ালে কুতুকুতুই ডাকে। পাখিওয়ালা খসরুর নাম হয়েছে হাগারু।