চুপচাপ তেল মালিশ কর। কথা বন্ধ।
কালু পায়ে তেল মালিশ করে যাচ্ছে। হারুন এমন ভঙ্গিতে বসে আছে যেন সে ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। চারপাশে কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। জহির উদ্দিন মারা গেছে এরচে আনন্দের সংবাদ আর কী হতে পারে। লটারিতে লাখ টাকা পাওয়ার আনন্দের মতো আনন্দ। হাতির মালিক মারা গেছে। হাতি এখন আর কাউকে ফেরত দিতে হবে না। পাওনা টাকাও দিতে হবে না। স্বাধীন বাংলা সার্কাস পার্টি এখন একটা হাতির মালিক।
কালু বলল, হাতির মালিক তো স্যার এখন আমরা।
হারুন বলল, আমরা হাতির মালিক হব কী জন্যে? জহির উদ্দিন সাবের ওয়ারিশানরা হাতির মালিক। কোর্টের কাগজপত্র নিয়া ওয়ারিশান আসলে হাতি ফিরত দিব।
ম্যানেজার সাব ভিন্ন কথা বলেছে।
কী ভিন্ন কথা?
ম্যানেজার সাব বলেছেন হাতি খরিদের বায়না দলিল গত মাসে করা হয়েছে। জাহির উদ্দিন সাব মাসে মাসে টেকা উসল হবে এই কড়ারে হাতি বেচে দিয়েছেন।
হারুন অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, চিন্তাভাবনার মধ্যে থাকি। পায়ে যন্ত্রণা। এইসব কারণে আসল কথা মনে থাকে না। হাতি যে আমরা খরিদ করে নিয়েছি এই কথাটা ভুলে গেছি। খরিদ অবশ্যই করেছি। কাগজপত্র ম্যানেজারের কাছে আছে। টাকা-পয়সাও যতদূর মনে হয় দেওয়া হয়ে গেছে। দেখি ম্যানেজারকে জিজ্ঞাস করি। অল্প কিছু যদি বাকি থাকে দিয়ে দেওয়া দরকার। ঋণ রাখা আমার পছন্দ না। ঠিক আছে তুমি যাও। আজ মনে হয় ব্যথা উঠবে না। ম্যানেজাররে পাঠাও! আমার গ্লাস খালি। গ্লাসে জিনিস দিয়ে যাও। তেঁতুলের জোগাড় দেখবা। এই জিনিস যদি আমারে তেঁতুল ছাড়া খাইতে হয় তাইলে তোমার খবর আছে। কানে ধইরা তাঁবুর চাইর দিকে তোমারে চক্কর দেওয়াব। বুঝেছ?
জি বুঝেছি।
ম্যানেজাররে পাঠাও। পা ছেছড়াইতে ছেছড়াইতে যাবা না। বন্দুকের গুলির মতো যাও।
কালু বিষণ্ণ মুখে বের হয়ে গেল। হারুন তেঁতুল বিহীন জিনের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বুঝল তার নেশা হয়েছে। জিনের নেশা হুট করে উঠে, তাই হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে তার যে জগৎ ছিল এখন সে জগৎ নাই। এখনকার জগৎ আন্দময় জগৎ। হঠাৎ হাতির মালিকানা পেয়ে যাওয়া একটা কারণ হতে পারে।
তৈয়ব এসে বলল, আমারে ডেকেছেন?
হারুন বিরক্ত গলায় বলল, না ডাকলে তুমি আস না? তুমি নবাব সিরাজউদ্দৌলা হয়েছ?
তৈয়ব মেঝেতে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখল। হারুন গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, জহির সাব ইন্তেকাল করেছেন–এই খবর কবে পেয়েছ?
গতকাল।
গতকাল খবর পেয়েছ, আমাকে দেও নাই কেন? না-কি ভুলে গেলা স্বাধীন বাংলা সার্কাসের মালিক আসলে কে? তুমি তো ভেবে বসে আছ তুমিই মালিক। মনে রাখবা তুমি দুই পয়সা দামের ম্যানেজার। এক মিনিটের নোটিশে পাছায় লাথি মেরে তোমারে রাস্তায় ফেলে দিতে পারি। পারি কি-না বলো।
জে পারেন।
এখন বলো এত বড় একটা সংবাদ লুকায়ে রেখেছ কেন?
তৈয়ব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। হারুন কড়া গলায় বলল, ফোস ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়বা না। বলো, কী ব্যাপার?
তৈয়ব শান্ত গলায় বলল, উনার মৃত্যুসংবাদ প্রচার করার আগে হাতিটা যে আমরা আগেই খরিদ করেছি এইটা প্রচার করা দরকার। তা না হলে সবেই ভাববে হাতির মালিক মারা গেছে আর আমরা হাতি মেরে দিয়েছি।
হারুন কিছু না বলে পরপর কয়েক দফা জিনের গ্লাসে চুমুক দিল। ম্যানেজারের প্রতি এই মুহূর্তে অত্যন্ত প্রসন্ন বোধ করছে হারুন। প্রসন্ন ভাবটা সে গোপন রাখবে কী রাখবে না বুঝতে পারছে না। বড় একটা দল চালাতে হলে অনেক কিছু ভাবতে হয়। বড় দল চালানোর কিছু কঠিন নিয়মকানুন আছে। একটা প্রধান নিয়ম হলো দলের কারো উপর খুশি হলে খুশি ভাব গোপন রাখতে হবে। যার উপর খুশি তাকে তা কখনো জানানো যাবে না।
তৈয়ব বলল, আমি যাই।
হারুন বলল, ঘটনা তো কিছুই শুনলাম না, যাই যাই করছ কেন?
হাতির অবস্থা ভালো না। পশু ডাক্তারের সন্ধানে যাব। সদরে একজন ভেটেনারি সার্জন আছে। তাকে নিয়ে আসব।
আচ্ছা যাও। একটা জিনিস শুধু খেয়াল রাখবা, আমি তোমার উপর বেজার। যে-কোনো সময় লাথি দিয়ে তোমাকে দল থেকে বের করে দিব। আমার এখানে কারো চাকরিই পার্মানেন্ট না। আমি যে কাউকে এক সেকেন্ডের নোটিশে দল থেকে বের করে দিতে পারি। নিজেকেও পারি। আমিই সার্কাস দলের মালিক। আমিই নিজেকে দল থেকে বের করে দিলাম। ভালো না?
জি ভালো।
জামদানী মেয়েটাকে আমার কাছে পাঠাও। হাতির বিষয়ে সে কী যেন কথা বলেছিল, কথাটা শুনি।
ওরা ঘুমায়ে পড়েছে।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে পাঠাও। দেশের যেমন বাদশা থাকে–সার্কাস দলেরও বাদশা থাকে। বাদশার হুকুম শুনতে হয়।
তৈয়ব বের হয়ে গেল। হারুন মাথায় ছোট্ট একটা চক্কর অনুভব করল। নেশা জমে গেছে। শরীর হালকা লাগছে। মনে ফুর্তির ভাব প্রবল হচ্ছে। এই সময়টা খারাপ। এখন যদি দুঃখের কোনো কথা মনে পড়ে তাহলে ফুর্তির বদলে মন ভরে যাবে দুঃখে। তখন টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকবে। নেশা খুব খারাপ জিনিস। শুরু হলো আনন্দের জন্যে, শেষ হলো দুঃখে। ভেউ ভেউ কান্না। চোখের পানি নাকের সর্দিতে মাখামাখি। সর্বশেষ ঘর ভাসিয়ে বমি। বমির উপর শুয়ে থাকা।
জামদানী ঘরে ঢুকল। সে কিছু বলার আগেই হারুন আনন্দিত গলায় বলল–কী খবর কী খবর কী খবর?
নেশা ভালোমতো ধরেছে। নেশার নিয়ম হলো ভালোমতো ধরলে সব বাক্য তিনবার চারবার করে বলা হয়। তারপরেও মনে হয় ঠিকমতো বলা হলো না। কিছু যেন বাকি থেকে গেল।