হারুন বসে বসেই এক পা এগুলো। নরম গলায় বলল, তোকে ব্যাটা বলেছি বলে মনে কষ্ট পাস নাই তো? আদর করে ব্যাটা বলেছি। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস কী জন্যে? তোর কী হয়েছে বল দেখি। কেউ কিছু বলেছে? তোর যদি স্পেশাল কিছু খেতে ইচ্ছা করে তাহলে বল–ব্যবস্থা করি। তেঁতুল খাবি? এক কেজি তেঁতুল এনে দেই। হারুন ভয়ে ভয়ে হাত বাড়াল। সে সার্কাস দলের মালিক। জন্তু-জানোয়ার নিয়েই তার কাজ। তারপরেও সে খুবই ভীতু ধরনের মানুষ। হাতির দিকে হাত বাড়াতে তার ভয় ভয় লাগছে।
হাতির গায়ে হাত লাগার আগেই হাতি শব্দ করে নড়ে উঠল। হারুন লাফ দিয়ে সরে গেল। সাহস দেখানোর কোনো দরকার নেই।
হারুন শোকরানা নামাজ অতি দ্রুত শেষ করল। তিন মেয়ের দড়ির খেলার সময় সে উপস্থিত থাকবে। আজ পর্যন্ত এমন কোনো দিন যায় নি যে তিন মেয়ে দড়ির খেলা দেখাচ্ছে আর সে সেখানে উপস্থিত নেই। মেয়ে তিনটাকে সে নিজে খেলা শিখিয়েছে। প্রথম যখন তিনবোন এলো তখন ছোটটার বয়স তিন বছর। তিনজনের একজনকে রাগ করে ধমক দিলে তিনজন মিলে একসঙ্গে কান্নাকাটি শুরু করে দিত। দেখে রাগও লাগত, আবার মায়াও লাগত। একজনের জ্বর হয়েছে কিছু খাবে না, বাকি দুজনও খাবে না। একজনকে নতুন কাপড় কিনে দিলে সে পরবে না। তিনজনকেই কাপড় কিনে দিতে হবে। মেয়েগুলিকে নিয়ে হারুনকে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। কষ্ট বৃথা যায় নাই। মানুষের কোনো কষ্টই বৃথা যায় না।
সার্কাসের দল টিকিয়ে রাখতে হবে মেয়ে তিনটার জন্যে। দল ভেঙে দিলে মেয়ে তিনটা যাবে কোথায়? এই তিন কন্যার যাবার জায়গা নেই।
রাত এগারোটা। হারুন সরকারের ঘরের দরজা বন্ধ। ঘরের ভেতর সে আছে আর আছে বাবুর্চির এসিসট্যান্ট কালু। হারুন সরকার পা ছড়িয়ে বসেছে। কালু পা টিপে দিচ্ছে। খুব আয়োজন করে পা টিপা হচ্ছে। একটা বাটিতে সরিষার তেল নেয়া হয়েছে। আরেকটা বাটিতে পানি। প্রথমে সরিষার তেল দিয়ে ডলা দেয়া হচ্ছে। সেখানেই পানি দিয়ে আবারো ডলা হচ্ছে।
হারুন সরকারের পায়ে সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে হাড়ির ভেতর যন্ত্রণা হয়। ভোতা ধরনের ব্যথা। কোনো কোনো দিন ভোতা ব্যথাটা শেষপর্যন্ত ভোতাই থাকে। কিন্তু মাঝে মধ্যে ব্যথা অসহনীয় হয়ে উঠে। আজ ব্যথা এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে, তবে তা তীব্র ব্যথায় মোড় নিতে পারে। হারুন সরকার ভীত ভঙ্গিতে বসে আছে। ব্যথার গতি বোঝার চেষ্টা করছে। কালুর হাতের কাছে দড়ি আছে। ব্যথা তীব্র হয়ে গেলে দড়ি দিয়ে শক্ত করে পা পেঁচিয়ে বাঁধতে হবে। হারুনের হাতে কালার গ্লাস। গ্লাসে কেরু কোম্পানির জিন। কাসার গ্লাসে কেরু কোম্পানির জিন খাওয়া হারুন শিখেছে তার ওস্তাদ মনু মিয়ার কাছে। মনু মিয়া জিনের সঙ্গে এক দুই বিচি তেঁতুল দিয়ে দিত। জিনিসটা হতো ভয়ঙ্কর। আজ তেঁতুল পাওয়া যায় নি। তেঁতুল ছাড়া জিন খেতে পানশা পানশা লাগছে। নেশা হবে বলে মনে হচ্ছে না। নেশা না হলে সমস্যা আছে। পায়ের ব্যথা সহ্য করা যাবে না।
কালু।
জি।
আজকের শো কেমন হয়েছে?
ফাটাফাটি হইছে। যারা দেখছে মরনের আগের দিনও তারার মনে থাকব।
আইটেম ভালো হয়েছে কোনটা?
সব আইটেম মারাত্মক হইছে। এ বলে আমারে দেখ, সে বলে আমারে দেখ।
তারপরেও তো উনিশ-বিশ আছে।
কালু গম্ভীর গলায় বলল, সবই বিশ। উনিশের কারবার আমরা করি না।
হারুনের মন এমনিতেই ভালো ছিল, কালুর কথায় মন আরো ভালো হলো। হারুনের কেন জানি মনে হচ্ছে ব্যথাটা আজ খারাপের দিকে যাবে না। পায়ে দড়ি বাঁধার প্রয়োজন পড়বে না।
খেলা খুব জমেছিল?
কালু গম্ভীর গলায় বলল, মারাত্মক। বিলাতি সাহেবের চউক উঠে গেছিল মাথার চান্দিতে।
হারুন আগ্রহ নিয়ে বলল, বিলাতি সাহেব ছিল না কি?
ছিল, দুইটা ছিল। ব্রিজ বানাইতেছে তার ইনজিনিয়ার। এর মধ্যে একজন বাংলা কথা পরিষ্কার বলতে পারে। সে আইসা হামকি ধামকি।
হামাকি ধামকি কী জন্যে?
বলে কী, দড়ির ডেনজারাস খেলা দেখাও? প্রটেকশন নাই। নিচে কেউ নাই। একসিডেন্ট হবে। মানুষ মারা যাবে। আমি মনে মনে বলি–যা ব্যাটা লালমুখা। মানুষ মারা গেলে আমরার যাবে। তোর বাপের কী?
আমি তো কিছু জানি না। এই ঘটনা কখন ঘটল?
শো শেষ হওনের পরে। ম্যানেজার সাহেবের সাথে কথা বলেছে। তোমরা শো করতে পারবে না। স্টপ। এইসব হাবিজাবি বলতে ছিল।
কই আমাকে তো ম্যানেজার কিছু বলল না।
সব কথা আপনের কানে তোলা হয় না। ম্যানেজার পেটের মধ্যে রেখে দেয়। পেট থেকে বাইর কইরা দুএকটা কথা বলে, বাকিগুলা ভাত-তরকারির সাথে হজম কইরা ফেলে।
তাই না-কি?
অবশ্যই। আমরার ম্যানেজারের পেট শক্ত। পেটে যেই জিনিস যায় সেইটাই হজম। আলীশান একটা খবর ম্যানেজারের কাছে আছে। ম্যানেজার আপনেরে দেয় নাই। দিব কি দিব না, তার নাই ঠিক।
কী খবর?
কালু চুপ করে গভীর মনোনিবেশে পা টিপছে। আলীশান খবর হুট করে বলে ফেললে খবরের মান থাকে না। হারুন বিরক্ত হয়ে বলল, খবরটা কী?
বগা চাচার ইন্তেকাল হয়েছে!
বগা চাচাটা কে?
জহির উদ্দিন সাবেরে সবেই ডাকে বগা চাচা। পাতলা পুতলা শইল, এই কারণে।
জহির উদ্দিনটা কে? ঠিক মতো জবাব দে। কথা পেঁচাইস না। কথা পেঁচাইলে লাথ দিয়া বিছনা থাইক্যা ফালায়ে দিব।
কালু আহত গলায় বলল, জহির উদ্দিন সাব হাতির মালিক। তারে আপনে নামে চিনবেন না সেইটা ক্যামনে বুঝব। লাথ মাইরা ফেলতে চাইলে ফেলেন। আমরা গরীব। আমরার জন্ম হইছে লাথ খাওনের জন্যে।