ও বুবু দেখ দেখ–কারবার দেখ!
পক্ষী খাওয়া-খাদ্য নিয়া ঝাপ্টা ঝাল্টি করে, এইগুলান কত দেখছি।
হারুন মনে মনে বলল, দূর হারামজাদী, এই জিনিস তুই তোর জন্মে দেখস নাই। তোর ভাগ্য ভালো তুই স্বাধীন বাংলা সার্কাসে ঢুকছস।
টিয়া খসরু এখন শেষ খেলা দেখাচ্ছে। সে হাত সোজা করে রেখেছে। ছটা পাখি তার হাতে বসা। এমনভাবে বসে আছে যেন এরা জীবন্ত পাখি না, এরা পুতুল। খসরু পাখিদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের খেলা দেখে দর্শকরা খুবই মজা পেয়েছেন। ইনাদের সালাম দাও। ডানা তুলে সালাম দাও।
পাখিগুলির প্রত্যেকটি তাদের বাম দিকের ডানা খানিকটা তুলল। একটা ডান দিকেরটা তুলে ফেলেছিল, অন্যদের দেখে ভুল সংশোধন করল। দর্শকরা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল।
খসরু বলল, এখন তোমরা ইস্কুলের ছাত্র। পড়া পার নাই। হোমওয়ার্ক কর নাই। মাস্টার শাস্তির হুকুম দিয়েছেন। এক ঠ্যাং-এ দাঁড়ানোর শাস্তি। দেখি এক ঠ্যাং-এ দাঁড়াও।
পাখি ছটাই এক ঠ্যাং-এ দাঁড়াল।
তুমুল তালি পড়ছে। শিস বাজছে। সার্কাস জমে গেছে।
পাখির আইটেম মোটামুটি দুর্বল আইটেম। এই আইটেমেই যখন পার পেয়ে গেছে অন্যগুলো উড়াল দিয়ে যাবে। খসরু ভালো দেখিয়েছে। তাকে সবুজ একটা পোশাক বানিয়ে দিতেই হবে। পপলিনের সবুজ কাপড় পাওয়া গেলে কালই দরজির দোকানে বানাতে দেয়া হবে। হারুন তাঁবু থেকে বের হলো। অজু করে দুরাকাত শোকরানা নামাজ পড়তে হবে। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা কী তার খোঁজ নেয়া দরকার। ভালো কাজ-কর্মের পরে ভালো খাওয়াদাওয়া দরকার। রাতে খিচুড়ি করতে বলা হয়েছিল। চাল-ডাল আর শজির খিচুড়ি। এখন মনে হচ্ছে সঙ্গে মাংস থাকা দরকার। খিচুড়ির সঙ্গে ঝাল গরুর মাংস।
হাতির খোঁজও নেয়া দরকার। হাতি খাওয়া-দাওয়া কি শুরু করেছে?
গোপনে হাত জোড় করে হাতিকে বলতে হবে, ভুল-ত্রুটি কিছু হলে ক্ষমা করে দাও। খাওয়া-দাওয়া কর। তুমি মারা পড়লে, আমি গরিব মানুষ, আমি জানে মারা পড়ব। আমার পুরা দল মারা পড়বে। হারুন মোটামুটি নিশ্চিত হাতি মানুষের কথা বোঝে। এবং সমস্ত পশু-পাখির মধ্যে হাতির অন্তরেই মায়া বেশি।
হারুন নামাজে দাঁড়াবার আগে হাতির ঘরে যাওয়া ঠিক করল।
পর্দা ঘেরা জায়গায় হাতিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাতি শুয়ে আছে। হাতির পাশে জামদানী বসে আছে। সে হাতির গুঁড়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দৃশ্যটা হারুনের ভালো লাগল। জামদানী নামের এই মেয়েটার অন্তরেও মহব্বত আছে। মহব্বত ছাড়া কিছু হয় না। সার্কাসের মতো বড় একটা দল এক সঙ্গে রাখতে হলে সবার জন্যে সবার মহব্বত থাকতে হবে। মানুষ মায়া করবে পশুর জন্যে, পশু মায়া করবে মানুষের জন্যে। সবাই বাধা থাকবে মায়ার শিকলে।
হারুন রাগি গলায় বলল, (নকল রাগ। আসমানী, জামদানী, পয়সা–এই তিন মেয়ের উপর সে কখনো রাগ করে না। কিন্তু ভাব দেখায় সারাক্ষণ রেগে আছে।) তুমি এইখানে কী কর? শো টাইমে সবসময় তৈরি থাকতে হয়। তুমি তো খেলার ড্রেসও এখনো পর নাই।
জামদানী কিছু বলল না। চুপ করে রইল।
শো টাইমে নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকবে। মনে মনে ইয়া মুকাদ্দিমু, ইয়া মুকাদ্দিমু এইটা জপবে। ইয়া মুকাদ্দিমুর অর্থ হলো–হে অগ্রসরকারী। তোমাদের খেলাটা রিস্কের খেলা। এই খেলায় মন স্থির রাখার জন্যে আল্লাখোদার নাম নিতে হয়। হাতির কাছে কী করতেছিলা?
কিছু না।
মেয়েছেলের হাতির ঘরে যাওয়া ঠিক না। তিনটা জায়গা আছে মেয়েছেলের জন্যে নিষিদ্ধ। পানের বরজ, হাতিশালা, আরেকটা জায়গার নাম মনে আসতেছে না। মনে আসলে বলব। নিষিদ্ধ কী জন্যে?
আরে কী যন্ত্রণা! নিষিদ্ধ কী জন্যে আমি জানি নাকি? আমি তো নিষিদ্ধ করি নাই। কথা বাড়াবা না। যাও, ঘরে যাও। দুই মিনিটের মধ্যে খেলার ড্রেসে তোমাকে দেখতে চাই।
জামদানী ক্ষীণ গলায় বলল, হাতিটার কী হয়েছে আমি জানি।
হারুন বিরক্ত গলায় বলল, ফাইজলামি কথা আমার সঙ্গে বলবা না। আমি ফাইজলামি কথা একেবারেই পছন্দ করি না। তুমি হাতির ডাক্তার না। তুমি দড়ি খেলার খেলোয়াড়। তোমার কাজ দড়ির উপরে। হাতির শুড় হাতানী তোমার কাজ না। এই জগতে সব মানুষের আলাদা আলাদা কাজ দেয়া আছে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাজ ঠিকমতো করবে। তাতে সংসার ঠিকমতো চলবে। বুঝেছ?
জি।
ঠিকমতো বুঝেছ? না এক কান দিয়ে ঢুকায়ে অন্য কান দিয়ে বার করে দিয়েছ?
ঠিকমতো বুঝেছি।
ঠিকমতো বুঝলে ভালো। আবার বেশি বুঝে ফেলবা না। বেশি বুঝে ফেললে খারাপ। তোমার বড় বোন আসমানী, সে সময় সময় বেশি বুঝে। আমি খবর পেয়েছি সে বাবুর্চিকে গিয়ে বলেছে সে তার তিন বোনের জন্যে আলাদা রান্না করবে। তিনজনের জিনিসপত্র তারে যেন আলাদা করে দিয়ে দেয়া হয়। এইসব কী ফাইজলামি? সার্কাসের দল হলো একটা সংসার। সংসারে দুই-তিন জায়গায় পাক হয় না। এক জায়গায় পাক হয়। বুঝেছ?
জি।
ঠিকমতো বুঝেছ?
জি।
যাও, ঘরে যাও। দুই মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে থাক। দোয়াটা যে। বলেছিলাম মনে আছে?
জি মনে আছে।
বলো দেখি।
জামদানী ভীত গলায় বলল, মনে নাই।
দোয়াটা হলো ইয়া মুকাদ্দিমু। যাও, জপতে জপতে যাও।
জামদানী চলে গেল। হারুন হাতির সামনে বসল। হাতি তাকিয়ে আছে তার দিকে। এত বড় একটা জানোয়ার অথচ কী পুতি পুতি চোখ। অথচ পেঁচার মতো ছোট পাখির কী বিরাট দুই চোখ? হারুন বলল, কীরে ব্যাটা, খাওয়া বন্ধ কী জন্যে? রাগ করেছ? বলেই মনে হলো ভুল হয়েছে। ব্যাটা হবে না। এটা মাদী হাতি। সার্কাসে কখনো মর্দ হাতি রাখা হয় না। সব সময় মাদী হাতি রাখা হয়। মর্দ হাতি সময় সময় মাথা গরম করে, তখন তাদের সামলানো কঠিন। মাদী হাতি কখনো মাথা গরম করে না।