বিপদজনক অবস্থায় দড়ির উপর দিয়ে অতি সাবধানে হেঁটে যাওয়া দেখেই দর্শকরা হতভম্ব হয়। যে দড়ির উপর হেঁটে যাচ্ছে তার জন্যে খানিকটা মায়াও হয়। মেয়েগুলি দড়ির এক প্রান্তে চলে এলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তখন শুরু হয়। আসল খেলা। মেয়ে তিনটি দড়ির উপর দৌড়াতে শুরু করে। লাফালাফি করছে, দৌড়াচ্ছে, হাসছে। সেই সঙ্গে বাজছে তুমুল বাজনা। দর্শকরা হৃদপিণ্ড গলার কাছে নিয়ে অপেক্ষা করছে। তাদের টেনশান আর সহ্য হয় না। খেলা শেষ হলে তারা বাঁচে। সার্কাস পার্টির জন্যে এরকম একটা আইটেমই যথেষ্ট। সেখানে স্বাধীন বাংলা সার্কাসের চার পাঁচটা ভালো আইটেম আছে। জাদুকর প্রফেসর মতিন আছে। যে তার সার্টের পকেট থেকে জ্বলন্ত আগুন বের করে সেই আগুনে সিগারেট ধরায়। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোয়া ছাড়ে কান দিয়ে। মুখে সিগারেট টানছে, ভুমভুম করে দুকান দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। ডিম থেকে পাখি বের করে সেই পাখিকে কাঠের বাক্সে রেখে ফু দিতেই পাখি হয়ে যায় খরগোস।
হারুন দর্শকদের পেছনের সারির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। দর্শক সমাগম ভালো। আজ প্রথম শো, অনেকেই পাশ নিয়ে ঢুকেছে, তারপরেও বলতে হবে দর্শক সমাগম ভালো। অনেক মহিলা এসেছে। মহিলা দর্শক আল্লাহর নেয়ামতের মতো। এরা পুরুষদের মতো বাড়িতে গিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকবে না। পাড়া বেড়াতে বের হবে। এর তার সঙ্গে গল্প করবে। যা দেখেছে তার চেয়েও বেশি বলবে। হারুন মহিলা গুনতে শুরু করেছে। আহারে, এক বেচারি কিছুই দেখতে পারছে না। তার বাচ্চাটা বড়ই বিরক্ত করছে। খুন খুন করে কাঁদছে। এটা একদিক দিয়ে ভালো। বাচ্চার মা আবারো আসবে। উপস্থিত থেকেও যে জিনিস দেখা যায় না তার মায়া বড়ই কঠিন মায়া।
পাখির খেলা শুরু হয়েছে। খাঁচায় ছটা টিয়া পাখি নিয়ে পাখিওয়ালা ঢুকেছে। পাখিওয়ালার নাম খসরু। তার চেয়ে রোগা মানুষ বাংলাদেশে দ্বিতীয় কেউ আছে কি-না সন্দেহ। যখন স্টেজে দাঁড়ায় তখন মনে হয় আরবি অক্ষর আলীফ দাঁড়িয়ে আছে। খসরু পাতিলের তলার মতো কালো। মাথার সমস্ত চুল পেকে যাওয়ায় মেন্দি লাগিয়ে সে চুল রঙ করেছে। এখন তার মাথা ভর্তি লাল চুল। লাল এবং কালোর কিস্তুত চেহারা। এটা একদিক দিয়ে ভালো, সার্কাসের লোকজনের চেহারা যত কিম্ভুত হবে তত ভালো।
হারুন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার প্রথমেই মনে হলো খসরুর পোশাকটা ঠিক হয় নাই। সাধারণ শার্ট প্যান্ট পরে ঢুকেছে। প্যান্টটা ময়লা। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। পাখিওয়ালাকে পোশাক কিনে দিতে হবে। সে টিয়াপাখির খেলা দেখায়, তার পোশাক হবে টিয়া পাখির মতো। সবুজ প্যান্ট, সবুজ শার্ট। মাথায় হলুদ টুপি। দূর থেকে দেখে তাকে যেন মনে হয় লম্বা একটা টিয়া পাখি।
দর্শকমণ্ডলী! নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী। আমি পাখিওয়ালা। আমার নাম খসরু। টিয়া খসরু। আমি ছয়টা টিয়া পাখি নিয়ে এসেছি। খাঁচার ভিতরে আছে বলে দূর থেকে আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। দিলাম খাচা খুলে।
খাঁচা খোলা হলো। ছয়টা পাখি নিমিষের মধ্যে খাঁচা থেকে বের হয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেল। টিয়া খসরু শূন্য খাচা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যান্ড বাদকের দল কিছুক্ষণ তুমুল বাজনা বাজাল। বাজনা থামার পর খসরু বলল–খাচা খুলে দিলে খাঁচার পাখি উড়ে যায়। আর ফিরে আসে না। দেখি এদের কী অবস্থা! আয় আয়–সবুজ পক্ষী ঘরে আয়।
খসরুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পাখি উড়ে উড়ে এসে খাঁচায় ঢুকতে লাগল। খসরু পাখি গুনছে–এক-দুই-তিন-চার…
দর্শকদের তালি পড়তে শুরু করেছে। তালিরও একটা ব্যাপার আছে। দর্শকদের মধ্যে সার্কাসের নিজস্ব কিছু লোক আছে। বাবুর্চি আছে, বাবুর্চির হেল্পাররা আছে। তাদের কাজ হলো প্রতিটা আইটেমের শেষে তালি শুরু করা। একজন শুরু করলে দশজন শুরু করে। সার্কাস জমে যায়। দৈ জমার জন্যে দৈএর বীজ দিতে হয়। সার্কাস জমার জন্যে দিতে হয় হাততালির বীজ।
টিয়া খসরু আবার কথা বলা শুরু করেছে। তার গলার আওয়াজ ভালো। এত দূর থেকেও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে।
দর্শকমণ্ডলী! নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, স্বামীস্ত্রী, লাইলী-মজনু অর্থাৎ প্রেমিক-প্রেমিকা… আপনারা খাওয়া-খাদ্য নিয়া মারামারি দেখেছেন। খাওয়া-খাদ্য নিয়া মানুষ মারামারি করে, জন্তু-জানোয়ার মারামারি করে। এক হাড়ি নিয়া দুই কুত্তার টানাটানি দেখেন নাই? অবশ্যই দেখেছেন। অখন দেখবেন দুই পাখির খাদ্য নিয়া টানাটানির খেলা।
দুটা টিয়া পাখি পাতলা একটা টোস্ট বিসকিটের দুপ্রান্ত ধরে উড়ছে। স্থির হয়ে উড়ছে, আবার চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে উড়ছে। দেখার মতো দৃশ্য। হাততালি শুরু হয়েছে। হাততালির সঙ্গে শিস দেয়ার শব্দ আসছে। একজন মহিলা মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়ে পাশের আরেক মহিলার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, বুবু দেখছ, কী আচানক!
পাশের মহিলা বলল, এইগুলা কিছু না–ট্রেনিং। ট্রেনিং দিয়া বানাইছে। ট্রেনিং দিলে পশু-পক্ষী পারে না এমন কাম নাই।
হারুন আগ্রহ নিয়ে মহিলাদের কথা শুনছে। কত ধরনের মানুষ কত ধরনের কথা বলে। কেউ কেউ জ্ঞানী, তাদের কাছে কোনো খেলাই ভালো লাগে না। আবার কিছু কিছু লোক আছে যা দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়। এরা মুগ্ধ হবার জন্যেই আসে। এরাই প্রকৃত দর্শক। এদের খেলা দেখিয়ে আরাম আছে। এদের জন্যেই সার্কাস।