টিকিট বিক্রির খবর নেই নাই।
খবর নেও নাই কেন?
টিকিট এখনো বিক্রি হইতেছে এই জন্যে খবর নেই নাই।
থানাওয়ালার কাছে লোক পাঠিয়েছিলে?
হুঁ।
সব ঠিক আছে?
হুঁ।
আর কোনো সমস্যা আছে?
বাজারের মসজিদের ইমাম সাহেব ঝামেলা করতেছে। বলতেছে সার্কাস হতে দিবে না।
উনার সমস্যা কী?
উনি বলেছেন যাত্রা, সার্কাস এইগুলো বেদাতি কাজ কর্ম। নাচ গান হয়। এইগুলো হইতে দিবেন না।
ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম দেখি।
আপনে চিন্তা করবেন না। ব্যবস্থা নিতেছি।
কী ব্যবস্থা?
তৈয়ব বিরস মুখ করে চুপ করে রইল। হারুন রাগী গলায় বলল, কী ব্যবস্থা নিতেছ শুনি।
তৈয়ব বলল, আমি ব্যবস্থা নিতেছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।
হারুন নিঃশ্বাস ফেলল। তৈয়বের উপর অবশ্যই ভরসা করা যায়। সে যখন বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে তখন বুঝতেই হবে যে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ভালো ব্যবস্থা। তৈয়বের মতো জোকার পাওয়া যেমন কঠিন তার মতো ম্যানেজার পাওয়াও কঠিন।
বাজনাদারদের দলকে পাঠায় দেও, একটা চক্কর দিবে। হাতির পিঠে করে পাঠাও।
বাজনাদার পাঠায়েছি। হাতির পিঠে দেই নাই। এরা ভ্যান গাড়িতে করে গেছে।
হাতির পিঠে দাও নাই কেন? হাতি দেখলে সবাই বুঝত আমাদের দল ভালো। পুতু পুতু দুধ-ভাত দল না। হাতি ঘোড়া আছে। সব কিছুর পাবলিসিটি লাগে।
তৈয়ব চুপ করে রইল।
খাম্বার মতো দাঁড়ায়ে থাকবা না, কথা বলো। হাতি পুন্দের চিপায় লুকায়ে রাখলা কোন হিসাবে?
হাতির শরীর ভালো না।
হারুন চমকে উঠে বলল, বলো কী! কী হয়েছে?
খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সর্বনাশ!
হারুনের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। হাতি তার নিজের না। হাতি পোষার মতো বড় দল তারটা না। হাতি ভাড়া করা। বায়নার টাকা ছাড়াও প্রতি শোতে তিনশ টাকা ভাড়া দিতে হয়। হাতির কিছু হলে হাতির মালিক জহির উদ্দিন তাকে ছাড়বে না। হাতির ভাড়া বাবদ জহির উদ্দিনের দশ হাজার টাকা পাওনা হয়েছে। পাওনা টাকার জন্যে যে-কোনোদিন লোক পাঠাবে। তখন কী উপায় হবে কে জানে।
তৈয়ব ঠাণ্ডা গলায় বলল, চিন্তা করবেন না।
হারুন রাগী গলায় বলল, বেকুবের মতো কথা বলবে না। বেকুবের মতো কথা আমার পছন্দ না। হাতি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, আমি চিন্তা করব না? আনন্দে নাচব! ব্যান্ড মাস্টারকে ডাক দাও। বাজনা বাজাক, আমি ড্যান্স দেই।
আমি ব্যবস্থা নিতেছি।
তুমি কী ব্যবস্থা নিবে? তুমি কি হাতির ডাক্তার? সব সময় ফাজিলের মতো কথা। যাও, সামনে থেকে যাও।
আপনি দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়েন।
ওরেব্বাসরে! তুমি তো শুধু হাতির ডাক্তার না, তুমি দেখি আবার মানুষেরও ডাক্তার। যাও যাও, সামনে থেকে যাও।
হারুনের মাথার দুপাশে দপদপ করছে। আবারো মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছে না। দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে থাকার উপদেশটা খারাপ না। ঘুম হবে না, কিন্তু ঝিমভাব আসবে। ঝিমভাবের কারণে মাথার যন্ত্রণা কমে যাবে। হারুন মনে মনে বিড়বিড় করল–আল্লাহপাক, আজকের দিনটা পার করে দাও। আর না, সব ছেড়ে ছুড়ে দিব। প্রয়োজনে মওলানা ডাকিয়ে তওবা করব। মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্ব করে আসব। মদিনা শরীফে গিয়ে নবিজির মাজার জিয়ারত করব। আজকের দিনটা পার করে দাও মওলা।
প্রবল হাসির শব্দ। মনে হচ্ছে এক সঙ্গে শতশত মানুষ হা-হা করছে। হাসির শব্দে তাঁবুর তিরপল খুলে মাথায় পড়ে গেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হারুন বিছানায় উঠে বসল। মাথার উপর তাঁবু পড়ে নি। সব ঠিকঠাক আছে। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার ঘুম না ভাঙিয়েই শো শুরু করে দিয়েছে। হাসির শব্দের উৎস জোকারের জোকারি। এখন নিশ্চয়ই ঘোড়া এবং তৈয়বের কথাবার্তা হচ্ছে। ঘোড়াকে ব্রা পরানোর চেষ্টা চলছে। যেভাবে হাসির শব্দ আসছে শো অবশ্যই জমে গেছে। ঘোড়ার খেলার পরই হবে পাখির খেলা। হালকা জিনিসের পরপরই ভারী কোনো কিছু দেয়া যায় না। পাখির খেলা সবসময় জমে না। মাঝে-মাঝে খুব জমে যায়, আবার মাঝে-মাঝে দর্শকরা চেঁচিয়ে উঠে–রন কর। বন কর। ঐ পক্ষীওয়ালা, বাড়িত যা। মাঝে মাঝে হাত তালিতে কান ফাটার উপক্রম হয়। আজ কী হবে কে জানে!
হারুন বিছানা থেকে নামল। তাঁবুর পেছন দিয়ে বের হয়ে দর্শকের দিক দিয়ে ঢুকল। দর্শক কেমন হয়েছে দেখা দরকার। পাখির খেলা জমে কি-না সেটাও দেখা দরকার। পাখির খেলা জমে গেলে বাকি খেলা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা নেই। শেষ আইটেম দড়ির খেলা। যার শেষ ভালো তার সব ভালো। দড়ির খেলাটা মারাত্মক। স্বাধীন বাংলা সার্কাসের আসল খেলা। তিন বোন দশ মিনিট ধরে খেলা দেখায়। এই দশ মিনিট দর্শকরা প্রাণ হাতে নিয়ে বসে থাকে। আঠারো ফুট উপরে দড়ি টানানো। তিন বোন প্রথমে দড়ির উপর দিয়ে সাবধানে হেঁটে যায়। তাদের দেখেই মনে হয় তারা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে খুব ভয় পাচ্ছে। এখনি পড়ে যাবে এখনি পড়ে যাবে ভাব। ভয় পাওয়ার কথা। দড়ির নিচে কোনো নায়লনের নেট নেই। একবার পড়লে অবশ্যই মৃত্যু। আগে নেট থাকত। দেখা গেল নিচে নেট বিছানো থাকলে দর্শকরা মজা পাচ্ছে না। কারণ তারা জানে দড়ির উপর থেকে পড়ে গেলে কোনো ক্ষতি নেই, ব্যাথা পাবে না। জালে আটকে যাবে। যেই নায়লনের নেট সরিয়ে দেয়া হলো অমনি খেলা জমে গেল। সার্কাসে মানুষ বিপদজনক খেলা দেখতে আসে। নিচে নায়লনের শক্ত নেট ফিট করে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটায় কোনো বিপদ নেই।