সার্কাস পার্টির আজ শো আছে। শোর আগে হারুন সরকারের মাথায় যন্ত্রণা হয়, প্রেসার বেড়ে যায়। বুকে চাপ ব্যথা হয়। তখন দীর্ঘ সময় ধরে মাথায় পানি ঢালতে হয়। পানি ঢালার কাজটা সব সময় করে আসমানী। দুলন্ত মাথায় নিশানা ঠিক রেখে পানি ঢালা খুবই কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজ আসমানী
আনন্দ নিয়ে করে। কাজটা মজার। তিন বোনই খুব মজা পায়।
এখন বাজছে পাঁচটা। শো শুরু হবে সন্ধ্যা সাতটায়। কখনো এত আগে থেকে পানি ঢালার প্রয়োজন হয় না। আজ প্রয়োজন পড়েছে, কারণ আজ প্রথম শো। প্রথমটা ধরে গেলে বাকিগুলিও ধরবে। প্রথমটা না ধরলে আর ধরবে না।
সার্কাসের জন্যে জায়গাটা ভালো। ইবাদত নগর। বড় গঞ্জ। সুতার কারখানা আছে, ইটের ভাটা আছে। মনু নদীর পাড়ে গঞ্জ। সেই নদীতে ব্রিজ বানানো হচ্ছে। শত শত মানুষ ব্রিজ বানানোতে লেগে আছে। সাদা চামড়ার কিছু সাহেব সুবাও আছে। এরা তাঁবু খাটিয়ে নদীর পাড়েই থাকে। ভাটি অঞ্চলের সঙ্গেও জায়গাটার যোগ আছে। ভাটি অঞ্চলের মানুষ আমোদ ফুর্তির জন্যে পয়সা খরচ করতে ডরায় না। যাত্রা-সার্কাসে ঘেটু গান এদের খুব পছন্দের জিনিস।
ইবাদত নগরের একটাই সমস্যা দুটা সিনেমা হল আছে। যেখানে সিনেমা হল আছে সেখানে সার্কাসের শো করা কঠিন। হল মালিকরা নানান ঝামেলা করে। যে কদিন সার্কাস চলে সেই কদিন সিনেমায় লোক হয় না। রুটি রুজির ব্যাপার, ওরা সমস্যা করবেই। স্থানীয় ক্ষমতাবান লোকরাও সমস্যা করে। তাদের সমস্যা অন্যরকম। তারা খোজ করে সার্কাসে মেয়ে কী আছে। তারা সার্কাসের মেয়েদের সঙ্গে প্রাইভেট আলাপ করতে চায়। থানাওয়ালাদেরও ব্যাপার আছে। থানাওয়ালাদের শুধু ফ্রি পাস দিলে হয় না। ফ্রি পাসের সাথে টাকাপয়সা দিতে হয়। তাদের খুশি রাখতে হয়। গঞ্জ মানেই গঞ্জের মাস্তান। সার্কাস যতদিন চলে এই মাস্তানরা সার্কাসের দলের সঙ্গেই থাকে। নানান ফদি-টন্দি করে এদেরকে ঠাণ্ডা রাখতে হয়। মদ খাওয়াতে হয়। টাকা-পয়সা দিতে হয়।
নতুন কোনো জায়গায় সার্কাসের দল নিয়ে যাওয়ার পর পর হারুন সরকার ঠিক করে–আর না, এই শেষ। দল ভেঙে দেয়া হবে, যে যার বাড়ি চলে যাবে। সে নিজে চলে যাবে নেত্রকোনায় তার গ্রামের বাড়িতে। দুতিনটা পুকুর কাটিয়ে পাঙ্গাশ মাছের চাষ করবে। আজকাল পাঙ্গাশ মাছের চাষ খুবই লাভজনক। কিংবা শুকনা মরিচের ব্যবসা করবে। সেটাও না পেলে জমি-জিরাত বেচে ছোট কোনো হোটেলে ঘর ভাড়া করে থাকবে। সে একা মানুষ। একটা মানুষের জীবন কাটানো কোনো সমস্যা না।
মাথায় পানি দেয়া শেষ হয়েছে, হারুন হাতের ইশারায় আসমানীকে পানি ঢালতে নিষেধ করল। আসমানী বলল, আপনার মাথার যন্ত্রণা কমেছে? হারুন সেই প্রশ্নের জবাব দিল না। মেজাজ খারাপ অবস্থায় কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কথা বললে সেই কথা মাথার ভিতরে চলে যায়। মাথার ভিতরে গিয়ে দপদপ করে।
হারুন বলল, যাও, সামনে থেকে যাও। তৈয়বকে পাঠাও।
আসমানী হাতের গামছা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, মাথাটা মোছেন।
হারুন বলল, মাথা মোছার দরকার নাই। আমার কি মাথা ভর্তি চুল আছে যে আধা ঘণ্টা ধরে মাথা ঘষাঘষি করতে হবে? চিন্তায় চিন্তায় মাথার সব চুল পড়ে গেছে। সামনে দাঁড়ায়ে থেকো না, তৈয়বকে পাঠাও। আরেকটা কথা–মাথায় পানি ঢালার সময় লক্ষ করেছি তোমার দুবোন আমাকে দেখায়ে দেখায়ে ফিক ফিক করে হাসাহাসি করতে ছিল। আমি তো জোকারি করতে ছিলাম না। হাসাহাসির কারণ কী? এইরকম যেন না হয়।
আসমানী বলল, আপনি ডাক দিয়ে ধমক দিয়ে দেন।
হারুন বলল, শোর আগে আগে আর্টিস্টকে ধমক দেয়া নিষেধ। এতে আর্টিস্টের মেজাজ খারাপ হয়। মেজাজ খারাপ হলে খেলা খারাপ হয়। দাঁড়ায়ে আছ কেন? তৈয়বকে খবর দিতে বললাম না?
তৈয়ব আলী দলের ম্যানেজার। বেটে খাট মানুষ। বিশাল শরীরের গোলগাল একজন মানুষ। শরীরের তুলনায় মাথাটা ছোট। ঠোট না নড়িয়ে সে কথা বলতে পারে। এই ক্ষমতাটা তার কাজে আসে। কারণ সে শুধু দলের ম্যানেজার না, সে সার্কাসের জোকার। জোকারকে কিছু বিশেষ বিদ্যা জানতে হয়। তৈয়ব আলী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একা আসর জমিয়ে রাখে। অতি সাধারণ কর্মকাণ্ডের মধ্যেও সে এমন কিছু করে যে দর্শকরা হেসে গড়াগড়ি খায়। শো শুরু হয় তাকে দিয়ে। সে হাড় জিরজিরে একটা ঘোড়া নিয়ে উপস্থিত হয়। দর্শকদের ঘোড়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়–এ আমার পরিবার, স্ত্রী, ওয়াইফ। সে কথা বলছে কিন্তু ঠোট নড়ছে না। পাথরের মতো মুখ। দর্শকরা শুরুতেই হকচকিয়ে যায়। ঘোড়াকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবার পর সে ঘোড়ার গায়ে হাত রেখে আদুরে গলায় বলে, ও আমার স্বপ্নের রানী, আদরের ঘোড়াকুমারী, কেমন আছ গো? তখন ঘোড়া ফোঁস করে উঠে গা ঝাড়া দেয়। তৈয়ব আহত গলায় বলে, ফোস ফোস করতেছ কেন? দর্শকদের হাসি শুরু হয়। হাসি চূড়ান্ত পর্বে যায় যখন সে পকেট থেকে একটা ব্রা বের করে ঘোড়াকে পরানোর চেষ্টা করে।
তৈয়ব এসে হারুন সরকারের সামনে দাঁড়িয়েছে। তার পাথরের মতো ভাবলেশহীন মুখ। সে দাড়িয়েছে মাথা নিচু করে দলের মালিকের চোখে চোখ রেখে সে কখনো কথা বলে না।
হারুন বলল, তৈয়ব, অবস্থা কী?
কীসের অবস্থা?
টিকিট বিক্রির কী অবস্থা?
মোটামুটি।
হারুন বিরক্ত গলায় বলল, মোটামুটি, ভালো, মন্দ–এই জাতীয় কথা আমাকে বলবে না। কত টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে?