জনাব ইয়াকুব সাহেব,
পর সমাচার এই যে আমি আমার তিন কন্যার দেখভালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আপনার হাতে দিয়া দিলাম। উপরে আল্লাহপাক, নিচে আপনি। আল্লাহপাক উসিলা বিনা কাজ করেন না। আপনি উসিলা। জনাব, মেয়ে তিনটির জন্যে বড় মনকষ্টে আছি। সর্বক্ষণ তাহাদের কথা মনে হয় এবং কলিজায় ব্যথা পাই। এখন আপনি নাদানের ভরসা। আমি আপনার পাক কদম চুম্বন করি। আপনি দয়া না করিলে আমার তিন আদরিণীর বড়ই বিপদ।
আমি যে জেলে আছি, কয়েদ খাটিতেছি–এই সংবাদ আমার কন্যাদের দয়া করিয়া দিবেন না। তাহারা মনে কষ্ট পাইবে। এম্নিতেই তাহারা কষ্টের মধ্যে আছে। তাহাদের কষ্ট আর বৃদ্ধি করতে চাই না। সুখে দুঃখে আমার দিন গুজরান হইতেছে। আমি আল্লাহপাকের খেলার মধ্যে পড়িয়াছি। তাহার খেলা বুঝিবার সাধ্য আমার নাই। রাত্রি নিশাকালে যখন নয়নে নিদ্রা আসে না তখন আল্লাহকে ডাকিয়া বলি, মাবুদে এলাহি, তুমি বান্দাকে নিয়া আর কী খেলা খেলিবে?
ইতি
আপনার গোলাম
জমির আলী
আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়ে আল্লাহ জমির আলীকে নিয়ে আরেকটি খেলা খেললেন। তখন রসুই খানায় রান্না হচ্ছে। বিশাল দুটা পিতলের ডেকচিতে লপসি রান্না হচ্ছে। জমির আলী প্রবল বেগে হাতা ঘুরাচ্ছে। চুলায় গানে আগুন। হাতা ঘুরানো বন্ধ হলে লপসি ধরে যাবে। পোড়া গন্ধ চলে আসবে। পাশের চুলায় হাতা ঘুরাচ্ছে কৃষ্ণ। জব্বলপুরের ছেলে। জমির আলীর বিশেষ ভক্ত। হঠাৎ সে হাতা ঘুরানো বন্ধ করে ভীত গলায় বলল, সাধুজী, ডেগ মে কিয়া। চুচুড়া!
কৃষ্ণ হাতায় করে জিনিসটা তুলল। সিদ্ধ হয়ে সাদা হয়ে যাওয়া একটা মরা চিকা। তার লম্বা লেজ হাতের বাইরে কিলবিল করছে। কৃষ্ণ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, রাম রাম। কিছুক্ষণ আগেই সে এই হাড়ির লাপসির লবণ দেখেছে। তার নাড়িভুড়ি উল্টে বমি আসছে।
হেড বাবুর্চি এবং রসুই মাস্টারকে খবর দেয়া হলো। রসুই মাস্টার ঠাণ্ডা গলায় বলল–এটা কোনো ব্যাপার না। চিকা নর্দমায় ফেলে দাও। চিকা গরমে সিদ্ধ হয়ে গেছে, কাজেই লাপসি নষ্ট হয় নাই। আরো কিছুক্ষণ শক্ত করে জ্বাল দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘটনা যেন প্রকাশ না হয়। ঘটনা যদি প্রকাশ হয়। এইখানে যারা কাজ করছে তাদের প্রত্যেককে সাতদিনের জন্যে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
জমির আলী বলল, ওস্তাদ কাজটা উচিত হবে না।
রসুই মাস্টার ক্ষিপ্ত গলায় বলল, দাড়িওয়ালা বান্দর আমাকে উচিত অনুচিত শিখায়। তোরে আমি মরা ইঁদুর খাওয়ায়ে দিব। খবরদার কেউ যেন কিছু না জানে।
এত সাবধানতার পরেও ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। লপসির সঙ্গে কয়েকটা মরা ইঁদুর আছে এই রকম গুজব দ্রুত রটে গেল। খেতে বসা কয়েদিরা ধুন্ধুমার কাণ্ড লাগিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে পুরো অঞ্চল রণক্ষেত্র। পাগলা ঘণ্টি বাজছে। একজন সেন্ট্রির মাথা ফুটন্ত ডালের কড়াইয়ে ডুবিয়ে দেয়া হলো। বিভৎস অবস্থা। কাঁদুনে গ্যাস, রবার বুলেট, সবশেষে সত্যিকার বুলেটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলো। দেখা গেল মারা গেছে দুজন। দুজনই ডিউটির সেন্ট্রি। আহত হয়েছে আঠারো জন। এই আঠারো জনের মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর। চারজনই গুলি খেয়েছে। বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
গোলাগুলিতে জমির আলীর তেমন কিছু হয় নি। ছোটাছুটি করতে গিয়ে উল্টে পড়ে তার শুধু দুটা দাঁত ভেঙ্গেছে। পায়ের একটা নখ উল্টে গেছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হলো না। পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে নির্জন সেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো। মিথ্যা গুজব রটিয়ে জেলে রায়ট সৃষ্টি করা, সেন্ট্রি এবং কয়েদি সংঘর্ষে যুক্ত থাকা, সেন্ট্রি হত্যা–এ ধরনের চারটি আলাদা আলাদা মামলায় তার এবং বাবুর্চির হেল্পার কৃষ্ণের সাত বছর করে সাজা হয়ে গেল। বলরামের হলো ফাঁসির হুকুম। সে একাই একজন সেন্ট্রির মাথা ফুটন্ত ডালে চুবিয়ে রেখেছিল। আলীপুর জেল থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো পাটনা জেলে। বলরামের সঙ্গে শেষ দেখার দিন বলরাম নখদর্পণের মাধ্যমে শেষবারের মতো জমিরের তিন মেয়ের খবর দিল। বলরাম স্পষ্ট দেখল–তিনটি মেয়েই ভালো আছে। সুস্থ আছে। বড় মেয়েটির গায়ে লাল রঙের নতুন একটা জামা। সবচে ছোটটির মাথায় সাদা রঙের উলের টুপি।
গরমের সময় মেয়েটার মাথায় উলের টুপি কেন পরিয়ে রেখেছে এই নিয়ে জমির আলী অত্যন্ত চিন্তিত বোধ করল। গরমের মধ্যে গরম টুপি। কী সর্বনাশের কথা। মাথা ঘামবে। শিশুদের মাথা ঘামলে দ্রুত ঠাণ্ডা লাগে। জমির আলী দুঃখিত গলায় বলল, কেউ খুশি হয়ে টুপিটা দিয়েছে। দুইবোন আদর করে টুপি পরিয়ে দিয়েছে। এরাও তো বাচ্চা মানুষ। এরা কি আর জানে কোনটায় শিশুর ক্ষতি হয়। কোনটায় হয় না।
বলরাম জমির আলীকে নানাবিধ সান্ত্বনার কথাও শোনাল। সাত বছর কোনো ব্যাপার না। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। পাটনা জেল জায়গা ভালো। ব্যবস্থাও ভালো। আবহাওয়া অতি মনোরম। নিজের ফাঁসির হুকুমে তাকে মোটেই চিন্তিত মনে হলো না। দানে দানে তিনদান হবার কথা। তিনদান হয়েছে। তার হাত দিয়ে তিনজন চলে গেছে। কপালে লেখা ছিল, লেখা ফলেছে। এতে চিন্তিত হবার কী আছে?
পনের বছর পরের কথা
পনের বছর পরের কথা।
আশ্বিন মাস। স্বাধীন-বাংলা সার্কাস পার্টির মালিক হারুন সরকারের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে, পানি ঢালছে আসমানী। জামদানী এবং পয়সা দুজনই আড়াল থেকে দৃশ্যটা দেখছে। দুজনের মুখেই চাপা হাসি। শুধু আসমানী গম্ভীর হয়ে আছে। গম্ভীর হয়ে থাকলেও তার চোখে হাসি চিকমিক করছে। তিন বোনের হাসি আনন্দের উৎস পানি ঢালার সময় হারুন সরকারের কর্মকাণ্ড। সে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো ক্রমাগত মাথা ডানে বামে দোলাচ্ছে। নিশানা ঠিক করে পানি ডালা যাচ্ছে না।