- বইয়ের নামঃ আসমানীরা তিন বোন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
বড় বোনের নাম আসমানী
বড় বোনের নাম আসমানী। আসমানীর সঙ্গে মিল রেখে তার পরের জনের নাম। জামদানী। তৃতীয়জনের জন্যে মিলের নাম খুঁজে পাওয়া গেল না। তার নাম পয়সা।
এত নাম থাকতে পয়সা নাম কেন–তার ইতিহাস আছে। জমির আলী তার তৃতীয় কন্যার জন্মের সময় খুবই অর্থকষ্টে পড়েছিল। সে বসে ছিল নদীর ঘাটলায়। খেয়া পারানি দেখতে দেখতে তার মনে অতি উচ্চশ্রেণীর চিন্তা-ভাবনা হচ্ছিল। যেমন–এমন কোনো ব্যবস্থা যদি থাকত যে, সন্তান জন্মের পরপর তাকে ওজন করা হবে। সরকারের কাছ থেকে ওজনের সমান সোনা সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেয়া হবে। মোটাসোটা বাচ্চা যাদের হবে তারা লাভবান, সোনা বেশি পাবে। চিকনা-চাকনাগুলি পাবে কম। মায়ের কোলে যেসব সন্তান মারা যাবে তাদের জন্যে আফসোস লাশ দাফনের খরচ ছাড়া কিছুই পাবে না।
জমির আলী মাটি কাটার কাজ করত। বর্তমানে ভিক্ষা করে। ভিক্ষা করার জন্যে সুন্দর সুন্দর জায়গা খুঁজে বের করে। খেয়াঘাট জায়গা হিসেবে ভালো। ভিক্ষা তেমন পাওয়া যায় না, তবে নৌকায় লোক পারাপার করে, দেখতে ভালো লাগে। কত কিসিমের মানুষ নামে। কেউ উদাস কেউ কুদাস। কুদাস শব্দটা জমির আলীর আবিষ্কার। কুদাস হলো উদাসের উল্টা। উদাস মানুষ দেখতে ভালো লাগে। কুদাস দেখতে ভালো লাগে না। জমির আলীর ধারণা। সে একজন উদাস মানুষ এবং ভাবের মানুষ। সে ভাবনা-চিন্তা ছাড়া থাকতেই পারে না।
ভাবনা-চিন্তার জন্যে ভিক্ষা পেশাকে তার আদর্শ পেশা বলে মনে হয়। সামনে একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালা রেখে ভাবনা-চিন্তা কর। কোনো সমস্যা নাই। মাঝে মধ্যে চলমান পাবলিকের দিকে তাকিয়ে বলা একটা পয়সা দিয়া যান। একটা পয়সা হারায়ে গেলে আপনের কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু একজনের জীবন রক্ষা হবে। কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকলেও হয়। যার দেবার সে চাইলেও দিবে, না চাইলেও দিবে। যে দিবে না তার সামনে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে এক ঘণ্টার বক্তৃতা দিলেও কিছু হবে না। খামাখা পরিশ্রম।
জমির আলী পরিশ্রম পছন্দ করে না। তার ধারণা আল্লাহপাক পরিশ্রম করার জন্যে মানুষকে তৈরি করেন নাই। পরিশ্রম করার জন্যে তিনি তৈরি করেছেন গাধা এবং মহিষকে। ফাজলামি করার জন্যে তৈরি করেছেন বানরকে। ময়লা ঘটার জন্যে তৈরি করেছেন শূকর এবং কাককে। একেক কিসিমের জন্তু একেক উদ্দেশ্যে তৈরি করা। মানুষও জন্তু। তাকেও একটা উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। উদ্দেশ্যটা কী, মাঝে-মধ্যে জমির আলী সেই নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করে। এখনো তেমন কিছু বের করতে পারে নি।
তার তৃতীয় সন্তানের জন্মের খবর যখন সে পায় তখন সে উদাস গলায় বলছিল–ভদ্রলোকের সন্তানরা, একটা পয়সা পঙ্গু মানুষটাকে দিয়া যান। (কথাটা সত্য না। সে পঙ্গু না। মাটি কাটার কাজ সে ইচ্ছা করলে এখনো করতে পারে, তবে ইচ্ছা করে না।) কন্যার জন্মের সময় পয়সা নামটা মুখে ছিল বলে। কন্যার নাম রাখা হলো পয়সা। সে তৎক্ষণাৎ মেয়ের মুখ দেখার জন্যে বাড়িতে রওনা হলো না। মেয়ের ভাগ্য কেমন দেখার জন্যে ঘণ্টা দুই খেয়াপাড়ে বসে রইল। মেয়ে ভাগ্যবতী হলে ভালো ভিক্ষা পাওয়া যাবে। দেখা গেল মেয়ের ভাগ্য খারাপ না। দুই ঘণ্টায় এগারো টাকা উঠে গেল।
মেয়ের পয়সা নামকরণের পর তার মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা এলো তা হচ্ছে–পয়সা জিনিসটা দেশ থেকে উঠে গেছে। ভিক্ষা করার সময় সে অবশ্যি চায় পয়সা। মানুষ দেয় টাকা। জিনিস উঠে গেছে কিন্তু নাম থেকে গেছে। পয়সা বলে কিছু নাই, কিন্তু পয়সা নামটা আছে! এরকম জিনিস আর কী আছে যে জিনিস নাই কিন্তু নাম আছে? জমির আলী গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। একই সঙ্গে জগতে চিন্তার বিষয় অনেক আছে এটা ভেবে সে নিশ্চিন্ত বোধ করে। চিন্তার বিষয় শেষ হয়ে গেলে তার জন্যে সমস্যা হতো। চিন্তা-ভাবনা ছাড়া অ্যালুমিনিয়ামের থালা নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকা কষ্টের ব্যাপার। হতো। মাটি কাটার চেয়েও কষ্টের হতো।
আছরের নামাজের সময় জমির আলী তার কন্যাকে দেখতে গেল। দুটাকার একটা চকচকে নোট আলাদা করা। মুখ দেখে মেয়ের হাতের মুঠোয়। ধরিয়ে দেবে। সে রাজা-বাদশা হলে মোহর দিয়ে মেয়ের মুখ দেখত। মেয়ের। হাতে এক মোহর। মেয়ের মায়ের হাতে এক মোহর। আল্লাহ তাকে ফকির বানিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, কাজেই দুটা গিনি সোনার মোহরের বদলে দুটাকার চকচকে নোট।
মেয়ের মুখ দেখে জমির আলী আনন্দিত গলায় বলল, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ, মেয়ে তোমার মতোই সুন্দরী হয়েছে। মাশাল্লাহ।
মেয়ের মা আছিয়া তীব্র গলায় বলল, ঢং কইরেন না কইলাম।
ঢং এর কী দেখলা? দেখি আবুরে কোলে দাও, তার জন্যে পুরস্কার আছে।
দূরে থাকেন। দূরে থাকেন কইলাম। আপনের পুরস্কারে আমি ঝাড়ু মারি।
জমির আলী আহত গলায় বলল, নিজের সন্তানরে কোলে নিব না? আমি জন্মদাতা পিতা।
আছিয়া তীব্র গলায় বলল, দূরে থাকেন কইলাম।
জমির আলী নিজেকে সংযত করে সহজ গলায় বলল, ঠিক আছে। মা বিনা অন্য কারোর কাঁচা আবু কোলে নেওন ঠিক না। গর্দানে ব্যথা পাইতে পারে। কাঁচা আবুর গর্দান পাটখড়ির মতো নরম।
খামাখা বকর বকর কইরেন না। নাই কাজের উজির। আসল পরিচয় পথের ফকির। ছিঃ ছিঃ।