তিনি গম্ভীর গলায় বললেন–কে? হুঁ আর ইউ।
চাচা আমি রেনু।
রেনুটা কে?
আমি ঐ বাড়িতে থাকি?
এখানে কি চাও?
কিছু চাই না।
আমাদের কথাবার্তা শুনে দুলু আপা বের হয়ে এলেন। তাঁর বাবার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন–তুমি ঘরে যাও বাবা।
উনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঘরের দিকে রওনা হলেন। রেলিং ধরে ধরে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে টলতে টলতে যাচ্ছেন। আমি আগে মাতাল দেখিনি–এই প্রথম দেখলাম। বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল।
দুলু আপা বললেন, বাসায় যা রেনু। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
আমি ক্ষীণ গলায় বললাম, যাচ্ছি।
তুই কি ভয় পেয়েছিস?
হুঁ।
কেন? বাবা কিছু বলেছে তোকে?
না।
তাহলে ভয় পেলি কেন? আয় আমি তোকে এগিয়ে দিচ্ছি।
এগিয়ে দিতে হবে না দুলু আপা।
আমি সিঁড়ি বেয়ে নামছি। হঠাৎ মনে হল আমি নিজেও অবিকল দুলু আপার বাবার মতই টলতে টলতে নামছি। এক হাতে সিড়ির রেলিং ধরে আছি। সিঁড়ির গোড়ায় এসে পেছনে ফিরলাম। দুলু আপা এখনো দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি খানিকটা মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। দুলু আপাকে আমি বেশ পছন্দ করি। তাঁকে যতটা পছন্দ করি নিজের আপাকে ততটা করি না। মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় মীরা আপা আমার বোন না হয়ে দুলু আপা বোন হলে বেশ হত।
তার মানে এই না যে আপাকে আমি পছন্দ করি না। করি। তবে কেন জানি খানিকটা ভয় ভয়ও লাগে। একজন মানুষ খুব পরিচিত একজনকে তখনি ভয় করে যখন সে তাকে বুঝতে পারে না। আপাকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আগে আমরা দুবোন একটা ঘরে ঘুমুতাম। বড় একটা খাট ছিল ঘরের মাঝখানে যাতে কাউকেই কিনারে শুতে না হয়। ঘুমুতে যাবার আগে আপা আমার চুল বেঁধে দিত। এই সময় হালকা গলায় গল্প গুজব করত। একদিন হঠাৎ বলল, রেনু, এখন থেকে তুই কি ভাইয়ার ঘরে শুবি? ওখানে তো এক্সট্রা চৌকি আছে। আমার একা ঘুমুতে ইচ্ছে করে।
আমি বললাম, আচ্ছা।
তুই মন খারাপ করলি না তো?
না।
মাঝে মাঝে আমার খুব একা থাকতে ইচ্ছা করে। সব সময় না, মাঝে মাঝে।
বুঝতে পারছি।
না বুঝতে পারছিস না। এটা এত সহজে বোঝার জিনিস না।
আমি চলে এলাম ভাইয়ার ঘরে। এম্নিতেই ঘরটা ছোট–তার উপর দুটা চৌকি। ঘরে ঢুকলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। তার উপর রোজ ভাইয়া রাত করে ফিরে। আমাকে দরজা খুলে দেবার জন্যে জেগে থাকতে হয়। ইদানীং আবার সিগারেট ধরেছে। ঘুমুবার আগে বিছানায় শুয়ে সিগারেট হয়ে যায়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কি বিশ্রী অবস্থা। আমি একদিন বললাম, সিগারেট বারান্দায় খেলে কেমন হয়?
ভাইয়া পা নাচাতে নাচাতে বলল, ভালই হয় কিন্তু সব কিছুর একটা নিয়ম আছে। দিনের শেষ সিগারেট বিছানায় শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে খেতে হয়, এটাই নিয়ম। নিয়ম তো ভঙ্গ করতে পারি না। এই জন্যেইতো পা নাচাচ্ছি।
আমার তো ভাইয়া দম বন্ধ হয়ে আসছে।
বুঝতে পারছি। বাট আই কান্ট হেল্প। আমার ঘরে বাস করলে এই কষ্ট সহ্য করতেই হবে। উপায় নেই।
ভাইয়ার সঙ্গে বাস করার কিছু অসুবিধা যেমন আছে–সুবিধাও আছে। প্রায় রাতেই সে অনেকক্ষণ গল্প করে। মজার মজার গল্প। মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। কিছু কিছু গল্প তার নিজের বানানো–যেমন আধুনিক কালের ঈশপের গল্প। পুরানো গল্প–কাক মাংসের টুকরা নিয়ে গাছে বসেছে, শিয়াল এসে বলল–কাক ভাই তোমার গলাটা বড় মিষ্টি। একটা গান গাও না। কতদিন তোমার গলার মধুর কী—কা ধ্বনি শুনি নি। ঈশপের গল্পে কাক তখন গান ধরে। কিন্তু ভাইয়ার গল্পে গান ধরে না। কারণ সৌভাগ্যক্রমে ঈশপের গল্পটি তার পড়া। সে এমন সব কাণ্ড কারখানা করে যে শুনে হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে আসে। এত কাণ্ড করেও কাকের শেষ রক্ষা হয় না–মাংসের টুকরা চলে যায় শিয়ালের পেটে। এই গল্পগুলি লিখে ফেললে চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যেত কিন্তু সে লিখবে না।
ভাইয়ার ঘরে একটা টেবিল ফ্যান আছে–এইটি সে দিয়ে রাখে আমার দিকে। সে না-কি হিট প্রুফ–গরমে তার কিছু হয় না, বরং সুনিদ্রা হয়। এটা অবশ্য মিথ্যা কথা। গরম অসহ্য বোধ হওয়াতেই সে তার কোন এক বন্ধুর কাছ থেকে এই যান নিয়ে এসেছিল। আমি তার ঘরে চলে আসায় বেচারাকে বাধ্য হয়ে যানটা আমাকে দিয়ে দিতে হয়েছে।
আপনি বোধ হয় ভাবছেন–মেয়েটা কি স্বার্থপর! নিজে ফ্যানের বাতাস খাচ্ছে–বড় ভাই গরমে সিদ্ধ হচ্ছে।
আসলে তা কিন্তু না। আমার ভাইয়ার মত চট করে ঘুম আসে না। ভাইয়া ঘুমুবার পরেও আমি অনেকক্ষণ জেগে থাকি। তারপর ফ্যানের মুখ ঘুরিয়ে দেই ভাইয়ার দিকে। ভাদ্রমাসের অসহ্য গরমে ছটফট করতে করতে ভাবি, একদিন যখন আমাদের খুব টাকা-পয়সা হবে তখন ঘরে ঘরে এয়ার কুলার থাকবে। সবগুলি ঘর থাকবে বরফের মত হিম শীতল। ভাদ্র মাসের গরমে লেপ গায়ে ঘুমুব।
রাত এখন বাজছে একটা দৃশ। আমি ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। বাবা অনেকক্ষণ C গে ছিলেন, কিছুক্ষণ আগে ঘুমুতে গেলেন। ভাইয়া রাতে ভাত খাবার সময় না থাকায় তিনি বেশ মন খারাপ করেছেন। কিছু দিন বাইরে কাটিয়ে ফিরলেই বাবা সবাইকে নিয়ে খাওয়ার ব্যাপারটায় খুব গুরুত্ব দিতে থাকেন। আজ বিকেলে তিনি নিউ মার্কেট থেকে কাতল মাছের একটা বিশাল মাথা কিনে এনেছেন। সেই মাথার মুড়িঘণ্ট রান্না হল। রান্নার সময় বাবা পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলেন এবং মাকে নানান উপদেশ দিতে লাগলেন–একটু ঝোল ঝোল রাখ, শুকনো হয়ে খেয়ে আরাম পাওয়া যাবে না। কয়েকটা আলু কুচি কুচি করে দিয়ে। দাও–আলু গলে ঝোলটা ঘন করবে, খেতে আরাম হবে। পাচ ফোরণ আছে? এক চিমটি পাঁচ ফোরণ ডোজ দিয়ে দাও না–সুন্দর গন্ধ হবে। গোটা পাঁচেক আস্ত কাঁচামরিচ দিয়ে দাও কাঁচামরিচের সুঘ্রাণ তুলনাহীন।