এবার বেশী করছে। এদের নিজেদের মধ্যে কোন মিল নেই। একজন আরেকজনকে দেখতে পারে না কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মিলের অন্ত নেই। তিনজন, মিলে আমাকে ভাজা ভাজা করে ফেলছে।
তাঁরা চান কি?
তারা চায় বাড়িটা যেন আমি ওদের লিখে দি। ওরা বাড়ি ভেঙ্গে মাল্টিস্টোরিড এ্যাপার্টমেন্ট হাউস করবে।
আপনি কি বললেন?
এখনো কিছু বলিনি–রঞ্জুর কাছে পরামর্শ চেয়েছি। সেও কিছু বলছে না।
ভাইয়ার কাছে পরামর্শ চেয়ে লাভ নেই চাচা–ও এমন পরামর্শ দেবে যে রাগে আপনার গা জ্বলে যাবে।
আরে না–কি যে তুই বলিস। ওর পরামর্শ প্রথমে খুব হাস্যকর মনে হলেও শেষে দেখা যায় ঠিক আছে।
আপনার মেয়েরা কি বলে চাচা?
ওরা হচ্ছে হিজ মাস্টারস ভয়েস–জামাইরা যা বলে ওরা তাই বলে। আমাকে বুঝাতে চায়–শিখিয়ে দেয়া কথা নিজের মত করে বলার চেষ্টা করে–ভাঙ্গা বাড়ি করবে বাবা? বিশাল মাল্টিস্টোরিড কমপ্লেক্স হবে। সবচে উপরের ফ্ল্যাটে থাকবে তুমি। হাত পা ছড়িয়ে বাস করবে। আমরা তিন বোন থাকব তোমার কাছাকাছি। এই বয়সে তো সেবা দরকার বাবা।
সুলায়মান চাচা চুপ করে গেলেন। তাকিয়ে আছেন টিভির দিকে। টিভিতে ক্লোজ আপে বেগুনের পাকা দেখা যাচ্ছে। ভয়ংকর লাগছে পোকাগুলিকে। আমি বললাম, চাচা যাই?
তিনি কোন জবাব দিলেন না। পোকা দেখতে লাগলেন যেন পোকাঁদের ভেতর পৃথিবীর সব সৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছে। সেই সৌন্দর্য আমাকে তেমন আকর্ষণ করল না। আমি ঠিক করলাম দুলু আপার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করব। যদিও আজ দুলু আপাদের বাড়ি যাওয়া নিষিদ্ধ। শুক্রবার সন্ধ্যার পর তাদের বাড়িতে যাওয়া যায় না। দুলু আপার নিষেধ আছে। ঐ দিন দুলু আপার বাবা মদ্যপান করেন। অল্পতেই তাঁর নেশা হয়। তিনি হৈ চৈ করে নানা কাণ্ড করেন। দুলু আপা চান না সেই দৃশ্য আমি দেখি। ঐ দৃশ্য দেখার জন্যেই আমার শুধু শুক্রবারেই তাঁদের বাড়ি যেতে ইচ্ছা। করে। বেশ কবার গিয়েছি এখনো কিছু দেখিনি।
আমি চলে গেলাম দুলু আপার ঘরে। দোতলার শেষ প্রান্তে দুলু আপার ঘর। ছোট্ট একটা খাট, সঙ্গে লাগোয়া চমৎকার ড্রেসিং টেবিল। আয়নাটা প্রকাণ্ড। আয়নার সামনে দাঁড়ালে এম্নিতেই মন ভাল হয়ে যায়। ঘরের এক কোণায় পুরনো ধরনের রেডিওগ্রাম। বেশীর ভাগ সময়ই দুলু আপার ঘরে ঢুকলে গান শোনা যায়। রেডিওগ্রামে সাতটা রেকর্ড চাপানো থাকে। শেষ হলেই নতুন রেকর্ড চাপানো হয়।
আজ গান হচ্ছে না। দুলু আপার ঘরও অন্ধকার। আমি দরজার ফাঁক করে দেখি ঠাণ্ডা মেঝেতে আঁচল বিছিয়ে দুলু আপা শুয়ে আছেন। এটিও তাঁর এক অদ্ভুত অভ্যাস সিমেন্টের মেঝে সব সময় ধুয়ে মুছে রাখেন। বেশীর ভাগ সময় শুয়ে থাকেন মেঝেতে হাতে বই।
দুলু আপা আসব?
আয়।
ঘর অন্ধকার কেন?
মাথা ধরেছে। আয় আমার পাশে বস।
আমি বসতে বসতে বললাম, চাচা কোথায়?
দুলু আপা সহজ গলায় বললেন, নিজের ঘরেই আছেন। বাবাও আমার মত ঘর অন্ধকার করে বসে আছেন। ঐ দিকে খবর্দার যাবি না।
চাচা কি করছেন?
জানি না কি করছে। আমের সরবত খাবি?
এখন তুমি আমের সরবত কোথায় পাবে?
ডীপ ফ্রীজে আম আছে। খেতে চাইলে বানিয়ে দেই। বেশীক্ষণ লাগবে না। দেব?
না।
অন্য কিছু খাবি?
উহুঁ। গান শুনব দুলু আপা।
দুলু আপা ক্লান্ত গলায় বললেন, আজ থাক। অন্যদিন শুনবি। আজ মনটা ভাল নেই।
আমি কি চলে যাব?
না। তোকে আমি একটা চিঠি পড়াব। মন দিয়ে পড়ে বলবি চিঠিটা কেমন হয়েছে।
তোমার লেখা চিঠি?
হ্যাঁ।
কাকে লিখেছ?
সেটা তোর জানার দরকার নেই। তুই শুধু পড়বি। বানান ভুল থাকলে ঠিক করে দিবি।
প্রেমপত্র নাকি?
এত কথার দরকার কি?
দাও পড়ি।
দুলু আপা হাসতে হাসতে বললেন, দেবো। এত ব্যস্ত কেন? চিঠি পড়ে তুই। একটা শক খাবি। এখন চুপচাপ বসে থাক। অন্ধকারে চুপচাপ বসে থাকার মধ্যে এক ধরনের মজা আছে। মাঝে মাঝে আমি কি করি জানিস? দরজা জানালা সব বন্ধ করে ঘর নিকষ অন্ধকার করি। তারপর মেঝেতে চুপচাপ বসে থাকি। অল্প কিছুক্ষণ বসে থাকলেই মনে হয়–অনন্তকাল পার হয়েছে। টাইম স্লো হয়ে যায়।
চিঠিটা দাও দুলু আপা, পড়ি।
দুলু আপা চিঠি দিলেন। রেডিওবণ্ড কাগজে গোটা গোটা করে লেখা দীর্ঘ চিঠি। বিষয়বস্তু হচ্ছে–পূর্ণিমা রাতে রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলি যদি নেভানো থাকে তাহলে নগরবাসীরা পূর্ণিমা উপভোগের সুযোগ পায়। ঢাকা মিউনিসিপ্যালটি কি এই কাজটি করবে? ভরা পূর্ণিমার সময় রাত ১১টা থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত রাস্তার সব বাতি নিভিয়ে দেবে? তখন তো চাঁদের আলোই থাকবে। কৃত্রিম বাতির প্রয়োজন কি?
চিঠিটা কেমন?
ইন্টারেস্টিং।
দুলু আপা হাসতে হাসতে বললেন, তুই মনে হয় আরো ইন্টারেস্টিং কোন চিঠি আশা করেছিলি? কি করেছিলি না?
হুঁ।
দুলু আপা বাতি নিভিয়ে দিয়ে বললেন, নিজ থেকে আমি কখনো কোন ছেলেকে চিঠি লিখব না। কখনো না।
লিখলে ক্ষতি কি?
ক্ষতি আছে। কেউ যদি আমার সেই চিঠি নিয়ে হাসাহাসি করে আমার খুব কষ্ট হবে।
এমন কাউকে লিখবে না যে তোমার চিঠি নিয়ে হাসাহাসি করবে।
যাকে লিখতে চাই সে তাই করবে। হাসহাসি করবে। সবাইকে পড়ে শোনাবে। চিঠির ভাষা নিয়ে ক্যারিকেচার করবে।
তোমার মনের কথা পৌঁছানো দিয়ে কথা। সে কি করবে না করবে তা দিয়ে তোমার প্রয়োজন কি?
তুই এসব বুঝবি না। আচ্ছা তুই এখন যা।
দুলু আপার ঘর থেকে বেরিয়েই দেখি সিঁড়ির মাথায় দুলু আপার বাবা। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, স্নামালিকুম চাচা।