মা কি ভাবে টাকা দিল? তার কাছে টাকা ছিল?
হুঁ ছিল। মেয়েরা খুব হুঁসিয়ার। কোন মেয়ে কেঁকের মাথায় কিছু করে না, তোর মা তার বাবার ব্যাগ থেকে নগদ তিনশ টাকা নিয়ে এসেছিল। তখনকার তিনশ মানে মেলা টাকা। আমরা দুই মাস এই টাকার উপর বেঁচে ছিলাম।
বাবা, তোমাদের জীবনের শুরুটা খুব সুন্দর ছিল। ছিল না?
প্রশ্নটা করেই মনে হল ভুল করেছি। এই প্রশ্ন করা উচিত হয় নি। বাবার হাসি হাসি মুখ করুণ হয়ে গেছে। তিনি তাকিয়ে আছেন অন্যদিকে। কারণ তাঁদের জীবনের শুরুটা খুব সুন্দর ছিল না। তাঁরা কঠিন দুঃসময় পার করেছেন। আমার নানাজান বাবার বিরুদ্ধে কেইস করে দিয়েছিলেন। ফুসলিয়ে নাবালিকা অপহরণের মামলা। পুলিশ চারমাস পর বাবাকে ধরে হাজতে পাঠিয়ে দেয়। মাকে পাঠানো হয়। নানাজানের কাছে। মা তখন অন্তসত্ত্বা। সব জানার পর নানাজান কেইস তুলে নিলেন তবে বাবাকে গ্রহণ করলেন না। মা পুরোপুরি বন্দি হয়ে গেলেন। তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম হল–আমাদের সবচে বড় বোন–নাম অরু। বাবা তাঁর প্রথম সন্তানের মুখ কোনদিন দেখতে পেলেন না। জন্মের পর পরই আমাদের বড় আপার মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুতে কোন রহস্য কি ছিল? হয়ত ছিল। আমরা জানি না জানতেও চাই না।
বৎসরের একটা দিনে মা দরজা বন্ধ করে সারাদিন কাঁদেন। বাবা শুকনো মুখে দরজার বাইরে মোড়ায় বসে থাকেন। আমরা জানি এই দিনটি হচ্ছে–বড় আপার মৃত্যু দিন। যে বড় আপার বয়স মাত্র একদিন–কিন্তু একদিন বয়স হলেও সে আমাদের সবার বড়। সে বেঁচে থাকলে আজ আমরা চার ভাইবোন বাবাকে ঘিরে বসে থাকতাম। সে থাকতে বাবার সবচে কাছাকাছি। বড় মেয়েরা তো সব সময়ই বাবার কাছের জন্ম হয়। তা ছাড়া সে আমাদের বাবা-মার ভালবাসাবাসির প্রথম ফুল।
বাবা চা শেষ করে খুশী খুশী স্বরে বললেন, এককাপ চায়ে তো তেমন জুত হল। সেকেণ্ড কাপ অব টি হবে না-কি? তোরা কেউ গিয়ে আরেক কাপ আন। তোর মা রান্নাঘরে বসে আছে কেন? আজ একটা বিশেষ দিন।
আপা বলল, বিশেষ দিনটা কি বলে ফেল না।
বাবা বললেন, অতিরিক্ত কৌতূহল ভাল না। বিশেষ করে বাবা-মার পার্সোন্যাল লাইফ সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের কোন রকম কৌতূহল থাকা উচিত না। যা হোক এইবার শুধু বলছি–আর কিছু জানতে চাইবি না। চাইলেও লাভ হবে না। বলব না। আজকের দিনটা খুব ইম্পর্টেন্ট কারণ … বাবা কথা শেষ করতে পারলেন না। মা রাগী মুখে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বললেন–চুপ করবে?
অহা শখ করে শুনতে চাচ্ছে।
তুমি যদি মুখ খোল আমি কিন্তু গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেব।
থাকি তাহলে বাদ দিলাম।
আপা বলল, তোমরা দুজন কোনখান থেকে ঘুরে আস না কেন? বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে খাও। এখানের রান্নাবান্না আমি করব।
বাবা বললেন, আইডিয়া খারাপ না। মিনু যাবে?
মা বললেন, মরে গেলেও না।
মার কথা এবং কাজ এক হল না। কিছুক্ষণের ভেতর মাকে দেখা গেল লজ্জা লজ্জা মুখে বের হচ্ছেন। বাবার গায়ে ভাইয়ার রঙিন সার্ট। সার্টটাকে এখন আরো বড় লাগছে। বাবাকে খুবই হাস্যকর দেখাচ্ছে। লম্বা সটি পরলে বেটে মানুষকে যে আরো বেঁটে লাগে তা আমার জানা ছিল না।
বাবা বেশ কিছু টাকা পয়সা নিয়ে এসেছেন। এও এক রহস্য। তাঁর ব্যবসা এমনই যে কখনো হাতে কিছু থাকে না। বাড়িভাড়া দেয়া হয় তো দোকানে বাকি থাকে। যেবার দোকান ক্লিয়ার করা হয় সেবার বাইরের কারোর কাছে ধার হয়।
এবার সব ধার মিটিয়ে দেয়া হল। তিন মাসের বাড়িভাড়া নিয়ে আমি দোতলায় উঠে গেলাম। সুলায়মান চাচা বসার ঘরে টিভির সামনে বসে ছিলেন। আমাকে দেখে শুকনো গলায় বললেন, কী খবর?
আমি বললাম, বাড়িভাড়া দিতে এসেছি চাচা।
ক মাসের?
তিন মাসের।
টেবিলের উপর রেখে দাও।
কেমন শুকনো গলা। যেন আমাকে চেনেন না। কিংবা চেনেন কিন্তু পছন্দ করেন না। এরকম হবার কথা নয়। সুলায়মান চাচা ভাইয়ার মত আমাকেও পছন্দ করেন। প্রসঙ্গ ক্রমে বলে রাখি, বেশীরভাগ মানুষই কিন্তু আমাকেও পছন্দ করে। আমি যাদের ভয়াবহ রকমের অপছন্দ করি তারাও আমাকে পছন্দ করে। সুলায়মান চাচা আজ এমন করছেন কেন বুঝতে পারলাম না। এমন না যে টিভিতে খুব মজার কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে। বেগুন চাষের সমস্যা নিয়ে টেকোমাথা এক লোক বকবক করছে। লোকটার হাতে বিরাট একটা বেগুন। সুলায়মান চাচা এক দৃষ্টিতে বেগুনটার। দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন পৃথিবীর যাবতীয় রূপ-রস-গন্ধ ঐ বেগুনটা ধারণ করে আছে। বাড়িভাড়ার টাকাটাও গুনে দেখছেন না। যে কাজটা তিনি সব সময় করেন। গোনা শেষ করে এমনভাবে তাকান যেন শখানেক টাকা কম হয়েছে। এই সময় আমার বুক টিপ টিপ করতে থাকে।
রেনু!
জ্বি।
রশিদ আমি পরে পাঠিয়ে দেব।
জি আচ্ছা।
জ্বি আচ্ছা বলার পরেও আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। তাকিয়ে আছি টিভির দিকে যেন আমিও ঐ বেগুনটাকে দেখে খুব মজা পাচ্ছি।
রেনু।
জ্বি।
বসবি না-কি?
আপনি বললে বসব।
সুলায়মান চাচা কিছু বললেন না। আমি নিজের থেকেই বসলাম। সুলায়মান চাচার ঠিক পাশে। যেন ইচ্ছা করলেই তিনি আমার পিঠে হাত রাখতে পারেন। মাঝে মাঝে কথা বলার সময় তিনি পিঠে হাত রাখেন। যেন আমি তাঁর সবচে আদরের ছোট একটা মেয়ে। সুলায়মান চাচার আদর করে কথা বলার এই ভঙ্গিটা আমার খুব ভাল লাগে।
রেনু!
জ্বি।
মনটা খুব খারাপ রে রেনু।
কেন?
জামাই তিনটা বড় বিরক্ত করছে।
সে তো সব সময়ই করে।