বাবা কিছুদিন বাইরে থেকে ফিরলে মা খানিকটা সাজসজ্জা করেন। কিছুটা নিজের ইচ্ছায় তবে বেশীরভাগই বাবার অনুরোধে। শাড়ি না পাল্টানো পর্যন্ত বাবা ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকবেন–
এতদিন পর আসলাম, তুমি ফকিরণী সেজে আছ ব্যাপারটা কি? শাড়িটা পাল্টাও তো। চুল টুল বাধে। একদিন রান্না না করলে কিছু যায় আসে না। না হয় হোটেল থেকে কিছু এনে খেয়ে নিলেই হবে। খাওয়াটা জরুরী না।
মাকে বাধ্য হয়ে সাজ করতে হয়।
তেমন কিছু না চুল বাধেন। চোখে কাজল দেন এবং তার একমাত্র গয়না কানের দুল জোড়া পরে ছেলে মেয়েদের সামনে লজ্জা সংকোচে এতটুকু হয়ে যান। আমরা এমন ভাব করি যে ব্যাপারটা কেউ লক্ষ্যই করছি না। কোন একটা ঠাট্টা করার জন্য ভাইয়ার জিব চুলকাতে থাকে। আমি চোখে চোখে ইশারা করি–যেন ঠাট্টা না করে।
বাবা অনেকদিন পর আসায় আমাদের দিনটা সুন্দরভাবে শুরু হল। আপা বলল, সে ইউনিভার্সিটিতে যাবে না। আপা যেখানে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে না, আমার সেখানে কলেজে যাবার প্রশ্নই উঠে না। ভাইয়া যে ভাবে বাবার সামনে পা ছড়িয়ে বসেছে তাতে মনে হয় সেও কোথাও যাবে না।
বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, তোর মাকে আজ তো দারুণ লাগছে। লক্ষ্য করেছিস? মনে হয় ষোল সতেরো বছরের খুকী! ঠিক না?
ভাইয়া বলল, খুব ঠিক।
বাবা বললেন, একটা ছবি তুলে রাখলে ভাল হত। আজ আবার আমাদের একটা বিশেষ দিন। বিশেষ দিন কেন সেটা আবার জানতে চাস না যেন। সব কিছু ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ডিসকাস করা যায় না। আমি মানুষটা ওড় ফ্যাশান্ড।
ভাইয়া বলল, আমাকে হিন্টস দাও। বাকিটা আমরা আন্দাজে বুঝে নেব। আজ যে তোমাদের বিয়ের দিন না তা জানি–তোমাদের বিয়ে হয়েছে আগস্ট মাসে, এটা হল জুন। এই দিনে তোমরা কি করেছিলে?
বাবা চোখ বন্ধ করে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। ভাবটা এমন যেন প্রশ্নটা শুনতে পান নি।
বাবা এবং মার অনেকগুলি বিশেষ দিন আছে। এই সব দিনগুলি তারা মনে রাখেন। একটাও ভুলেন না। এবং তাদের মত করে দিনগুলি পালনও করা হয়। কয়েকটা বিশেষ দিন আমরা জানি যেমন মে মাসের দু তারিখ–তাদের প্রথম দেখা। আগষ্ট মাসের আট তারিখ বাবার সঙ্গে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসা। নানান ধরনের নাটকীয় কাণ্ড এই দুজন করেছেন। বাবার পক্ষে সবই সম্ভব কিন্তু মার মত শান্তি, সরল এবং খানিকটা বোকা বোকা ধরনের মহিলার পক্ষে কি করে সম্ভব তা কখনো ভেবে পাই না। মা যে কাণ্ড করেছেন, আমি বা আপা কখনো এসব করতে পারব বলে মনে হয় না।
একটা ছেলে যার সঙ্গে কোন কথা হয় নি শুধু দূর থেকে চোখে চোখে দেখা–সে এক সন্ধ্যায় কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি আমার সঙ্গে চল। যদি না যাও রেল লাইনে শুয়ে পড়ব। ওমি মা, যার বয়স মাত্র পনেরো, তিনি বাড়ির কাউকে একটা কথা না বলে বের হয়ে গেলেন। এটা কি করে সম্ভব হল, কে বলবে? আমি মাকে একবার খুব শক্ত করে ধরলাম–একটা ছেলেকে তুমি চেন না জান না। তোমাদের মধ্যে কোন কথাও হয় নি। সে এসে বলল, আর তুমি ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলে। কেন এটা করলে বল তো?
মা বিরক্ত হয়ে বললেন, বাদ দে তো–। দুদিন পর পর এক কৃথা। বাদ দে।
না বাদ দেব না। বলতে হবে।
মা ভেজা ভেজা গলায় বলল, ঐ সন্ধ্যায় তোর বাবার সঙ্গে না বের হলে তো সে রেল লাইনে শুয়ে পড়ত। সেটা ভাল হত?
সে রেল লাইনে শুয়ে পড়ত তা কি করে বুঝলে?
বুঝা যায়। আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলল।
ছেলেরা বানিয়ে বানিয়ে এ জাতীয় কথা অনেক বলে।
তোদের সময় বলে। আমাদের সময় বলতো না।
না বলতো না–তোমাদের সময় তো ছেলেরা মহাপুরুষ ছিল? সদা সত্য কথা কহিত।
চুপ কর তো।
তুমি খুব বোকা ছিলে মা। খুবই বোকা। বাবা না হয়ে অন্য কোন ছেলে হলে তোমার কি যে হত কে জানে।
যথেষ্ট হয়েছে, চুপ কর।
বাবাকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম, খুব সিরিয়াস গলায় বলেছিলাম, আচ্ছা বাবা, মা যদি ঐ দিন তোমার সঙ্গে না যেত তুমি কি সত্যি সত্যি রেল লাইনে শুয়ে পড়তে?
বাবা গলা নীচু করে বলেছিলেন, পাগল হয়েছিস? ঐদিন কথার কথা হিসেবে বলেছিলাম। তোর মা যে বের হয়ে চলে আসবে কে জানত। যখন সত্যি সত্যি বের হয়ে এল–মাথায় সপ্ত আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এমন ভুৱা বয়সের মেয়েকে নিয়ে যাই কোথায়? পকেটে নাই পয়সা। স্টেশনে গিয়ে বসে আছি–তোর মা ক্রমাগত কাঁদছে। একবার ভয়ে ভয়ে বললাম–বাড়িতে ফিরে যাবে? তোর মা কাঁদতে কাঁদতে বলল–না। আমি মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ পাক, তুমি আমাকে একি বিপদে ফেললে। ইউনুস নবী মাছের পেটে বসে যে দোয়া পড়েছিলেন–ক্রমাগত সেই দোয়া পড়ছি–লাইলা-হা ইল্লা আনতা সোবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জুয়ালেমিন।
দোয়ায় কাজ হল?
খানিকটা হল। ট্রেনে উঠার পর তোর মার কান্না থেমে গেল।
হাসি শুরু করলেন?
না। গল্প শুরু করল। দুনিয়ার গল্প। এত গল্প যে তার পেটে ছিল কে জানত? আমার কান ঝালাপালা করে দিল। মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি তখন সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে জাগায়। বিরাট যন্ত্রণা। তার উপর আখাউড়া স্টেশনে টিকিট চেকার এসে টিকিট চাইল। সাড়ে সর্বনাশ। টিকিট কাটি নি।
কাটনি কেন?
পয়সা কোথায় টিকিট কাটব?
তখন কি করলে?
এই সব শুনে লাভ নেই। বাদ দে।
বাদ দেব কেন বলনা শুনি।
তোর মা টাকা দিল। ফাইন দিয়ে টিকিট কাটলাম। আজকাল যেমন বিনা ভাড়ায় চলে যাওয়া যায় কেউ কিছু বলে না। আমাদের সময় খুব কড়াকড়ি ছিল।