দুলু আপা হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, আজকের খবরের কাগজটা নিতে এসেছি।
ভাইয়া বলল, ভল জায়গায় এসেছ আমরা খবরের কাগজ রাখি না। একটা কাগজের দাম তিন টাকা। ত্রিশ গুনন তিন, মাসে নব্বই টাকা–ফর নাথিং চলে যায়। নব্বই টাকায় ছ সের চাল হয়।
দুলু আপার সঙ্গে কখনো ভাইয়া এই ভঙ্গিতে কথা বলে না। সেবার বলল তার কারণ জ্বর তার মাথায় উঠে গেছে। সে কি বলছে নিজেও জানে না।
আমরা ভাইয়াকে বাথরুমে ঢুকিয়ে কল ছেড়ে দিলাম। দুলু আপা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন। পুরোপুরি গেলেন না, তাদের দোতলার বারান্দার এক কোণায় পঁড়িয়ে রইলেন, যেখান থেকে আমাদের ঘরের অনেকটা দেখা যায়।
ভাইয়ার জ্বর নামতে নামতে দুটা বেজে গেল। তখনো দুলু আপা দাঁড়িয়ে। আমি উঠোনে গিয়ে বললাম, আপা ভাইয়ার জ্বর নেমে গেছে।
দুলু আপা যেন আমার কথা শুনতে পাননি এমন ভঙ্গিতে বললেন, বেনু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জোছনদেখছিলাম। কি সুন্দর জোছনা হয়েছে দেখেছিস? দুলু আপার ভাবটা এমন যেন সারাক্ষণ তিনি জোছনা দেখার জন্যেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভাইয়ার জ্বর কমল কি না কমল সে ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ নেই।
কি কথা থেকে, কি কথায় চলে এসেছি–শুরুতে কি বলছিলাম যেন? ও আচ্ছা–আয়না। হ্যাঁ আমাদের বাসায় কোন আয়না নেই। তিন মাস ধরেই নেই। এবং এই নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথাও নেই। ভাইয়া বরং একটু খুশী। আমাকে বলল, আয়না না থাকার একটা বড় সুবিধা কি জানিস? রোজ নিজেকে দেখতে হয় না। মানুষ নিজেকে যেমন ভালবাসে নিজেকে তেমন ঘৃণাও করে। ঘৃণার মানুষটাকে রোজ দেখতে হচ্ছে না এটা আনন্দের ব্যাপার না?
আয়না না থাকার কষ্ট মীরা অপর সবচে বেশী হওয়ার কথা। সুন্দরীরা বার বার নিজেকে দেখতে চায়। রূপকথার রাজকন্যাদের মত আয়নার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে–বল তো সুন্দরী কে আমার চেয়ে? কিন্তু আপাকেও নির্বিকার মনে হচ্ছে। একদিন সে শুধু নীচু গলায় বলল, আমার নিজের চেহারাটা কেমন আমি ভুলে গেছি। সত্যি ভুলে গেছি। মজার ব্যাপার কি জানিস ভুলে গিয়ে ভালই লাগছে।
ঠিক দুমাস এগারো দিন পর, আমাদের বাসায় নতুন আয়না এল। বাবা কাঠের ফ্রেমের বেশ বড় সড় একটা আয়না নিয়ে অনেকদিন পর উদয় হলেন এবং হাসিমুখে বললেন–খবর সব ভাল?
সেই আয়না বারান্দায় টানানো হল। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখি দুটা মুখ দেখা যাচ্ছে।
বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন, এরকম হচ্ছে কেন? আমি তো দেখে শুনেই কিনলাম। বদলানোর তো কোন উপায় নেই, বদলাতে হলে চিটাগাং যেতে হয়। চিটাগাং থেকে কেনা।
ভাইয়া বলল, বদলানোর দরকার কি? একটার জায়গায় দুটা মুখ দেখা যাচ্ছে। ভালই তো। একের ভেতর দুই। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল–একটা মুখকে হাসিখুশী দেখায় অন্যটা গম্ভীর। জ্যাকেল এণ্ড হাইড।
বাবা হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, ফানি ম্যান। ভেরি ফানি ম্যান।
বাবা এবার খুব হাসি খুশী
বাবা এবার খুব হাসি খুশী হয়ে ফিরেছেন। সব বার এরকম হয় না। যতবার বাইরে থেকে আসেন তাঁকে ক্লান্ত লাগে, মনে হয় খানিকটা বয়স যেন বেড়েছে। মাথার কয়েকটা চুল বেশী পাকা। চোখের নীচটা যেন আগের চেয়েও সামান্য বেশী ঝুলেছে। এবার ব্যতিক্রম হল। বাবার মাথার সব চুল কুচকুচে কাল। পান খাওয়ার কারণে দাঁতে যে লাল ছোপ ছিল তাও নেই। ঝকঝকে সাদা দাঁত। টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন হিসেবে চালিয়ে দেবার মত দাঁত।
ভাইয়া বলল, চুলে কলপ দিয়েছ নাকি?
বাবা খানিকটা লজ্জা পেলেন। লজ্জা ঢাকার তেমন চেষ্টা করলেন না। লাজুক গলাতে বললেন, চুল কাটতে গিয়েছি। কাটা শেষ হলে নাপিত বলল, ওয়াশ করে দেব না-কি স্যার? আমি বললাম, দাও। খানিকক্ষণ পরে দেখি এই অবস্থা। ওয়াশ মানে যে কলপ তাতো জানতাম না।
ভাইয়া বলল, দাঁতের এই অবস্থা করলে কি করে? স্যাঁতও ওয়াশ করেছ?
আরে না। ডেনটিস্টের কাছে গিয়েছিলাম দাত তুলতে। সে ক্লীন করে দিল।
ভাইয়া বলল, তুমি তোমার বয়স দশ বছর কমিয়ে নিয়ে এসেছ? একটা রঙচঙা হাফসার্ট পরলে তোমার বয়স পনেরো বছর কম মনে হবে। দেব একটা সার্ট?
কি কাণ্ড, গোসল করে বাবা সত্যি সত্যি রঙ্গিন সার্ট পরলেন। তার নিজের না, ভাইয়ার। লাল নীল ফুল আঁকা বাহারী সার্ট। মাপে খানিকটা বড় হল। কারণ ভাইয়া হচ্ছে প্রায় ছফুটের কাছাকাছি। তাতে অসুবিধা হল না। বাবাকে সার্টে খুব মানিয়ে গেল। তাঁকে যুবক ছেলের মতই দেখাতে লাগল। তিনি বারান্দায় মোড়ায় বসে পা নাচাতে নাচাতে সিগারেট টানতে লাগলেন। যেন তিনি পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষ। গাঢ় গলায় বললেন, কই চা দাও তো, আরাম করে এককাপ চা খাই।
মা চা নিয়ে বের হলেন। আমরা দ্বিতীয়বার চমকালাম। মার পরণে নতুন শাড়ি। এই শাড়ি বাবা নিয়ে এসেছেন। বাবা সম্ভবত কালার ব্লাইণ্ড। কালার ব্লাইণ্ড না হলে এমন ভয়াবহ রঙের শাড়ি কেনা সম্ভব না। মালটি কালার শাড়িতে মাকেও খুকী খুকী লাগছে। খুকী খুকী লাগার প্রধান কারণ মা কানে দুল পরেছেন। চুল টান টান করে বেণী করেছেন। এমন সাজগোজ করে মা লজ্জায় মরে যাচ্ছেন। কোনমতে বাবার সামনে চায়ের কাপ বেখে রান্নাঘরে পালিয়ে বাচলেন। মার সঙ্গে আমরা ঠাট্টা তামাশা বিশেষ করি না। কারণ তিনি রসিকতা বুঝতে পারেন না। কেঁদে ফেলেন। ভাইয়া যদি ঠাট্টা করে বলতো, ব্যাপার কি মা? আজ কি তোমার বিয়ে? তাহলে মা নিশ্চয়ই চায়ের কাপ ছুড়ে ফেলে চিৎকার করে কেদে একটা কাণ্ড ঘটাতেন।