একটা লোক যে তাকে এত পছন্দ করে তা নিয়ে ভাইয়ার কোন মাথাব্যথা নেই। যেন সে ধরেই নিয়েছে সবাই তাকে পছন্দ করবে।
মজার ব্যাপার–করছেও তাই। আমাদের পেছনেই থাকেন ব্যারিস্টার মুশফেকুর রহমান। তিনি তাঁর দোতলা বাড়ি এত বড় করে বানিয়েছেন যে আমরা শীতের সময় ভোরের রোদ পাই না। অসম্ভব ব্যস্ত এই মুশফেকুর রহমান সাহেবের সঙ্গেও ভাইয়ার খাতির আছে। এই খাতির কি ভাবে হল আমরা জানি না। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলে সে হাসে। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার রাত নটার দিকে মুশফেকুর রহমান সাহেব লোক পাঠিয়ে দেন–ভাইয়াকে তাঁর প্রয়োজন। একহাত দাবা খেলবেন। ভাইয়া দাবা খেলতে যায়–রাত এগারোটা বারটার দিকে ফিরে। তার মুখে হাসি।
কি ভাইয়া হারলে না জিতলে?
প্রথম দিকে উইন করছিলাম। একটা পণ এবং দুটা পিস আপ ছিল। শেষটায় যুবলেট করে দিয়েছি।
প্রতিবারই তো শুনি একই ব্যাপার।
ব্যারিস্টার সাহেব শুরুতে খুব খারাপ খেললেও শেষের দিকে সামলে খেলেন। একেকটা দুর্দান্ত চাল দিয়ে–ছেড়াবেড় করে দেন।
ব্যারিস্টার সাহেবের সবচে ছোট মেয়ে দুলু আপাও যে আমাদের মত গরীব মানুষদের বাসায় আসা যাওয়া করে আমার ধারণা তার একমাত্র কারণ ভাইয়া।
দুলু আপা তাদের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে গল্প করেন। তখনি করেন যখন ভাইয়া উঠানে থাকে। আমি মনে মনে হাসি। প্রকাশ্যেই হাসতাম–তা হাসি না কারণ দুলু আপাকে আমি খুব পছন্দ করি।
চমৎকার মেয়ে। হিস্ট্রিতে অনার্স ফাইনাল দেবেন। খুব ভাল ছাত্রী। দিনরাত হাতে বই। চাপা ধরনের মেয়ে। একটু পাগলাটে ভাব আছে। হয়ত ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আমি কলেজে না গিয়ে বাসায় বসে আছি। দুলু আপাদের বাসার কাজের লোক আমার জন্যে চিঠি নিয়ে এল। চিঠিতে লেখা–রেনু, খুব বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজবে? যদি রাজি থাক–চলে আস। আমরা গাড়ি করে গ্রামের দিকে চলে যাব।
তারপর রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে বৃষ্টিতে ভিজব।
একদিন কথামত গেলাম। গাড়ি জয়দেবপুর ছাড়িয়ে চলে গেল। মোটামুটি নির্জন একটা জায়গা বের করে দুলু আপা বললেন, ড্রাইভার সাহেব থামেন তো। ড্রাইভার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে বসে রইল–আমরা বৃষ্টিতে ভিজে এলাম। দুলু আপা কয়েকবার বলল, ইন্টারেস্টিং লাগছে, না রেনু?
আমার মোটেই ইন্টারেস্টিং লাগছিল না–তবু বললাম, দারুন লাগছে।
দুলু আপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, পুরোপুরি নগ্ন হয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে পারলে আরো চমৎকার হতো–তাতো আর সম্ভব না।
যে মেয়ে এ জাতীয় কথা বলে তার মাথায় ছিট আছে তাতো বলাই বাহুল্য।
দুলু আপার মত ভাবুক, অসম্ভব রোমান্টিক, আবেগতাড়িত একটি মেয়ে ভাইয়ার মত মানুষের জন্য দুর্বলতা পোষণ করা স্বাভাবিক কিন্তু তাই বলে এতটা কি উচিত? তাও যদি ভাইয়ার সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হত। চোখের দেখাতে প্রেম গল্প উপন্যাসে হয়। বাস্তবে প্রেমে পড়ার জন্যে একজনকে অন্যজনের কাছাকাছি যেতে হয়। ভাইয়া এবং দুলু আপা, দুজন দুপ্রান্তের মানুষ।
ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হলে ভাইয়া তার স্বভাবমত রসিকতা অবশ্য করে। কিন্তু দুলু আপাকে দেখে বোঝার কোন উপায়ই নেই–তিনি এই রসিকতাগুলি পছন্দ করছেন কি করছেন না। হয়ত দুলু আপা ভোরবেলায় আমাদের বাসায় এসেছেন। ভাইয়া মেঝেতে বসে দাড়ি কামাচ্ছে। যেহেতু আয়না নেই দাড়ি কাটতে হচ্ছে সম্পূর্ণ অনুমানের উপর। দুলু আপাকে দেখে ভাইয়া খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল–
তারপর দুলু, খবর ভাল?
জ্বি ভাল।
হিস্ট্রি পড়ছ কেমন? ভাজা ভাজা করে ফেলছ নাকি?
ভালই পড়ছি।
আচ্ছা বল তো দেখি সম্রাট শাহজাহানের খালা শাশুড়ির নাম কি? দশটাকা বাজি। তুমি বলতে পারবে না।
দুলু আপা তার উত্তরে কিছু বলবে না–পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকবে। তাকে দেখে তখন মনে হওয়া অস্বাভাবিক না যে দাড়ি কামানোর দৃশ্যই হচ্ছে পৃথিবীর সবচে সুন্দর দৃশ্য।
ভাইয়া নিরাসক্ত ধরনের মানুষ। কোন কিছুতেই তার আসক্তি নেই। যখন পয়সা হচ্ছে–ধুমসে সিগারেট টানছে। টাকা পয়সা শেষ–নির্বিকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে দেখে মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়–সে চোখবন্ধু একজন মানুষ। তাকিয়ে আছে কিন্তু তেমন কিছু দেখছে না। যদি দেখত তাহলে অবশ্যই বুঝতে পারত দুলু আপী গভীর আগ্রহে তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। যে আগ্রহে তিল পরিমাণ খাদ নেই।
ভাইয়া যখন ব্যারিস্টার সাহেবের সঙ্গে দাবা খেলেন, দুলু আপা তখন বসার ঘরে পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেই দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে থাকে। থর থর করে কাঁপতে থাকেন। আমি একদিন দৃশ্যটা দেখে ফেললাম। অবাক হয়ে বললাম, কি হয়েছে আপা?
দুলু আপা বিব্রত গলায় বললেন, কিছু হয়নি তো।
এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন?
দুলু আপা ফিস ফিস করে বলল, এম্নি। এম্নি দাঁড়িয়ে আছি। বলতে বলতে তার চোখ ভিজে উঠল। গলা ধরে গেল।
ভাইয়ার যেবার একশ পাঁচ জ্বর হল তখন কি পরিমাণ অস্থিরতা যে দুলু আপার দেখেছিলাম তা কখনো গুছিয়ে বলতে পারব না। মানুষ খুব অস্থির হলে নানা ভাবে সেই অস্থিরতা প্রকাশ করে। কাঁদে, হৈ চৈ করে। দুলু আপা অস্থিরতা প্রকাশ করতে পারেন না। নিজের মধ্যে চেপে রাখেন। তার কষ্টও সীমাহীন। জ্বর নামানোর জন্যে যখন আমরা ধরাধরি করে ভাইয়াকে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছি–শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে জ্বর নামাবো। তখন দুলু আপা আমাদের ঘরে এলেন। তাকে দেখে মনে হল, ভাইয়াকে ধরে নিয়ে যাবার কাজটির বিনিময়ে তিনি তার সমগ্র জীবন এক কথায় দিয়ে দিতে পারেন। ভাইয়া দুলু আপার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি খবর দুলু? ভাল? অসময়ে কি মনে করে?